মো. মাজহারুল পারভেজ
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ০২:৪৩ এএম
আপডেট : ৩১ মে ২০২৪, ০৭:১৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এক প্লটে ভবন বানাতে দুই নকশা

নেপথ্যে কোটি টাকা লেনদেন
এক প্লটে ভবন বানাতে দুই নকশা

একই প্লটে ভবন নির্মাণের জন্য আলাদা দুটি নকশার অনুমোদন দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। দুবারই প্লটটি খালি দেখিয়ে আবেদন করা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা তখন যথাযথ প্রক্রিয়ায় তথ্য যাচাই করেননি, সেই সুযোগে প্রথম নকশায় দেখানো ফাঁকা জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে আরেকটি ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় এই নকশায় প্রথম ভবনের জায়গাটি ফাঁকা দেখানো হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত জালিয়াতি ধরা পড়ায় ভবন দুটির নির্মাণকাজ বন্ধ এবং রাজউকের তিন কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজধানীর উত্তরখানের মাজার চৌরাস্তায় ২০ কাঠার একটি প্লটে বেজমেন্টসহ দশতলা ভবন নির্মাণের জন্য ২০২১ সালে নকশা অনুমোদন করে রাজউক। ওই নকশায় প্লটের অর্ধেক ফাঁকা রাখা হয়। নকশাটি পাস হওয়ার পর প্লটের উত্তর পাশে খালি রেখে দক্ষিণের ১০ কাঠায় বেজমেন্টসহ দোতলার কাজ সম্পন্ন করা হয়। এরপর ওই ভবনের জায়গাটি খালি দেখিয়ে ২০২২ সালে আরেকটি নকশার অনুমোদন নেওয়া হয়। এরপর খালি জায়গাটিতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে আরেকটি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। এরই মধ্যে দুটি ভবনেরই দোতলার কাজ শেষ করেছেন জমির মালিকরা।

রাজউকের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ২০ কাঠার ওপর ১০ তলা ভবন নির্মাণ করতে হলে জমির অর্ধেক খালি রেখে নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। কিন্তু উত্তরার ওই জমির মালিকরা তা না করে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে পুরো ২০ কাঠা জমিতে পরপর দুটি ভবন নির্মাণ করছে। তারা রাজউকের ৩০৭নং ফরমের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষকে অবহিত না করে ইমারত নির্মাণকাজ চালায়। বিষয়টি জানার পর গত ১২ মে রাজউকের সভায় এই ভবনের নকশা বাতিল ও ভবন নির্মাণকাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়।

উত্তরখান থানার অফিসার ইনচার্জ আবু ছাঈদ আল মামুন কালবেলাকে জানান, ‘রাজউক থেকে এ-সংক্রান্ত একটি পত্র আমরা পেয়েছি। নির্মাণকাজ বন্ধ রাখার জন্য এরই মধ্যে লিখিতভাবে ভবন মালিকদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

উত্তরখান মৌজার মাজার চৌরাস্তা এলাকার ফজিরবাতান এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যায়, ভবন দুটি নির্মাণকাজে ইমারতবিধি অনুসরণের কোনো বালাই নেই। চারপাশে ছাড়া হয়নি কোনো জায়গা। দুটি ভবনেরই সাইনবোর্ডেই সিএস দাগ নং ৮৮৩/৮৮৪ (পাট), আরএস দাগ নং ২৬৭৫/২৬৮২ও এবং এমএস দাগ নং ২৩৪৮৭/২৩৪৮৪ মৌজা উত্তরখান, ঢাকা-১২৩০ উল্লেখ করা হয়েছে।

ভবন দুটির কাজ সমাপ্তির তারিখ লেখা আছে ৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৬। দুটি সাইনবোর্ডেই ভবনের স্থপতি হিসেবে শেখ আরিফুল আলম এবং প্রকৌশলী এ কে এম শফিক পাটোয়ারীর নাম লেখা রয়েছে।

রাজউকের নথি ঘেঁটে দেখা যায়, আসাদুজ্জামান গং ২০২১ সালের ৭ মার্চ বেজমেন্টসহ আবাসিক কাম বাণিজ্যিক (এ-২, এফ-৫) ১০ তলা ইমারত নির্মাণের প্ল্যানের অনুমোদন গ্রহণ করে। ভবনটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এসটি কনস্ট্রাকশন। এতে দোতলা পর্যন্ত হবে বাণিজ্যিক। আর তিনতলা থেকে দশতলা পর্যন্ত ৩২টি আবাসিক ফ্ল্যাট থাকবে। অন্যদিকে এই তথ্য গোপন রেখে ২০২২ সালের ৬ মার্চ রাজউকের অনুমোদন নেওয়া আরেকটি নকশায়ও দোতলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক দেখানো হয়েছে। সেখানেও তিনতলা থেকে দশতলা পর্যন্ত ৩২টি ফ্ল্যাট রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে এই ভবনটির দোতলার ছাদ ঢালাই শেষ হয়েছে।

এলাকাবাসী জানান, উত্তরখান থানার সাবেক অফিসার ইনচার্জ (ওসি) হেলাল উদ্দিন (বর্তমানে ডিএমপিতে কর্মরত) ও পরিদর্শক আফতাব শেখসহ পুলিশের ১৬ সদস্যসহ মোট ৬৪ জন মিলে ২০ কাঠার প্লটটি কিনে ভবন নির্মাণ শুরু করেন। তাদের সবার বাড়ি গাজীপুর। চারপাশে কোনো জায়গা না ছেড়ে ভবন নির্মাণের বিষয়টি শুরুতেই অনেকের নজরে আসে। তবে এই কাজের সঙ্গে পুলিশ সদস্যরা জড়িত থাকায় কেউ মুখ খোলেননি। তা ছাড়া উদ্যোক্তাদের প্রায় সবাই রাজউকের তৎকালীন চেয়ারম্যান আনিছুর রহমানের এলাকার লোক।

প্লট মালিকদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কালবেলাকে জানান, তারা জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে এই জমিটি কিনেছেন। রাজউকের পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) মোবারক হোসেন, আগের অথরাইজড অফিসার মাহাবুব হোসেন (বর্তমানে সংসদ ভবনে কর্মরত) ও বর্তমান অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী পলাশ সিকদার তাদের এই বিপদে ফেলেছেন। এ চক্রটি অবৈধভাবে প্রায় কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলেও অভিযোগ তাদের।

তারা আরও জানান, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান চলে যাওয়ার পরই এই প্রজেক্টে ঝামেলা বাধে। রাজউকের স্থানীয় এক দালাল ইলিয়াস হোসেনের মাধ্যমে তারা রাজউকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই প্ল্যান পাস করান বলে জানান ভবন মালিকরা। তবে এ ঘটনার পর এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন ইলিয়াস। বন্ধ রয়েছে তার মোবাইল ফোনও।

রাজউকের অথরাইজড অফিসার প্রকৌশলী পলাশ সিকদারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘অ্যাকশনে যাওয়া ছাড়া রাজউকের হাতে আর কোনো অপশন নেই। তবে মালিকরা এ বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। রিট করলে হয়তো আদেশ তাদের পক্ষেও চলে আসতে পারে। আদেশ পেলে পরে আবার কাজ করতে পারবে।’

তার বিরুদ্ধে টাকার বিনিময়ে জালিয়াতিতে সহযোগিতার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন।

ভবন নির্মাণ কমিটির চেয়ারম্যান পুলিশ পরিদর্শক আফতাব শেখ জানান, ‘রাজউকের নিষেধাজ্ঞার খবর পেয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।’

ঝামেলা তৈরি হওয়ায় আগের কমিটি বিলুপ্ত করে তাকে নতুন কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে অবৈধ লেনদেন করে কীভাবে এই প্ল্যান পাস করানো হয়েছে, তা তার জানা নেই।

আরেকটি ভবন কমিটির চেয়ারম্যান পরিদর্শক হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘অজ্ঞতার কারণে আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। সব হারিয়ে আমরা আজ সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। আমরা এ ঘটনায় জড়িত রাজউকের কর্মকর্তাদের বিচার চাই।’

ভবন মালিকদের একজন আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা চাই অবৈধভাবে যারা প্ল্যান দিয়েছে রাজউকের সেই কর্মকর্তাদেরও যেন আইনের আওতায় আনা হয়। আমরা রাজউকের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে তাদের বিচার দাবি করেছি।’

এদিকে রাজউক কীভাবে একই প্লটে দুটি নকশার অনুমোদন দিল, সে বিষয়ে জানার জন্য সংস্থাটির পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ-২) মোবারক হোসেন ও আগের অথরাইজড অফিসার মাহাবুব হোসেনকে বারবার ফোন দেওয়া হলেও তারা ধরেননি। পরে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠানো হলেও জবাব দেননি।

জালিয়াতির এই ঘটনা অবহিত করে মন্তব্য চাওয়া হলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘ভবন নির্মাতারা সুযোগ নিতেই চাইবে। ডিজাইন, প্ল্যান, সুপারভিশন ও মনিটরিংয়ে পরিদর্শকসহ রাজউকের যেসব কর্মকর্তা এমন জঘন্য অপরাধে জড়িত থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অতীতে তাদের বিরুদ্ধে কখনো ব্যবস্থা নেওয়ার নজির নেই। বর্তমান চেয়ারম্যান এসব অপরাধ আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই শর্ষের ভেতরে থাকা ভূত তাড়ানো যাবে।’

এ বিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সিদ্দিকুর রহমান সরকার কালবেলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যে ওই প্লটের নকশা বাতিল করা হয়েছে। নির্মাণকাজও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় রাজউকের যেসব কর্মকর্তা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

তার সঙ্গে ভবন মালিকদের সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি তাদের দ্রুত ভবন দুটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। এসব অনৈতিক কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি দাখিল শিক্ষামন্ত্রীর

পদ্মা সেতুর জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে সম্মান পেয়েছে : প্রধানমন্ত্রী

কুড়িগ্রামে বিদ্যুৎস্পর্শে দুই বোনসহ তিনজন নিহত

বৈঠক ব্যর্থ, নতুন করে যে ঘোষণা দিল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নেতারা

বিমান থেকে পড়েও বেঁচে গেছেন যে ভাগ্যবান নারী

ছাত্রছাত্রীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার আহ্বান প্রতিমন্ত্রী রিমির

সেন্টমার্টিন নিয়ে বিরূপ মন্তব্যকারীরা স্বাধীনতাবিরোধী : পর্যটনমন্ত্রী

লন্ডনের চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশি ‘লতিকা’

টানা চতুর্থবার ব্রিটিশ এমপি হওয়ায় টিউলিপ সিদ্দিককে বিএমএর অভিনন্দন

১০০ মা পেলেন মাদার্স ডে পুরস্কার

১০

আয়কর ফাঁকি দেওয়ায় বন্ধ দুই লাখ সিম

১১

অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য মালয়েশিয়াকে স্পিকারের আহ্বান

১২

‘আপনার জিয়া ভাই আর নেই’

১৩

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কোনো আপস নেই : সমবায় প্রতিমন্ত্রী

১৪

নোয়াখালীতে কাভার্ডভ্যান চাপায় প্রাণ গেল ভাইবোনের

১৫

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ চবি শিক্ষার্থীদের

১৬

গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক

১৭

গাজায় ইসরায়েলের ১০ সেনা নিহত

১৮

ভয়াবহ রূপ নিয়েছে কুড়িগ্রামের বন্যা, সীমাহীন দুর্ভোগ

১৯

কোটাবিরোধী আন্দোলনে সংহতি জানাবে বিএনপি

২০
X