আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনায় বাগড়া দিতে পারে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হারের অস্থিতিশীলতা। এ কারণে সরকার যে বাজেট পরিকল্পনা সাজাতে যাচ্ছে, সেখানে ডলারের দামে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতিকে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যের বেশ কিছু জায়গায় সবিস্তারে এই অস্বস্তির কথা উঠে আসবে। একই সঙ্গে ডলার দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সরকারের সম্ভাব্য অতিরিক্ত ব্যয়ের একটি পূর্বাভাসও তুলে ধরা হবে বাজেটকেন্দ্রিক পরিকল্পনা সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি বিবৃতিতে। খবর অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি শাখা সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ বিষয়ে শাখা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখার পরিকল্পনায় বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়হারের সম্পর্ক ওতপ্রোত। বিশেষত ডলার দামে অস্থিতিশীলতা চলতে থাকলে প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার যে ব্যয় পরিকল্পনা রাখতে যাচ্ছে, বছর শেষে সেই হিসাবে বড় ধরনের ব্যাঘাত তৈরি করবে। কারণ, ডলারের দাম যত বাড়ে বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধে ব্যয়, প্রকল্পজনিত আমদানি ও পরামর্শক ব্যয়, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ভর্তুকি ব্যয় এবং আমদানি দায় ও সেবার রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির বিপরীতে সরকারের প্রচ্ছন্ন দায়জনিত ব্যয়ও তত বাড়ে।
অর্থ বিভাগের হালনাগাদ তথ্য বলছে, বর্তমানে সরকার এ ধরনের বৈদেশিক দায়ের যে স্থিতি তার ৫০ শতাংশই পরিশোধ করতে হয় মার্কিন ডলারে। এর বাইরে জাপানিজ ইয়েনে পরিশোধ করা হয় ঋণ স্থিতির ২১ শতাংশ, ইউরোতে ১৫ শতাংশ, আরএমবিতে ৯ শতাংশ, ব্রিটিশ পাউন্ডে ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য মুদ্রায় ২ শতাংশ।
ডলার দামে ঊর্ধ্বগতির প্রভাব পড়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সার্বিক বৈদেশিক দায় পরিশোধের হিসাবে। অর্থাৎ ব্যয় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে যেখানে শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসল পরিশোধে সরকারকে খরচ করতে হয়েছে ১৯ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা, সেখানে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ১০ মাসে এ খাতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণের দায় পরিশোধে খরচ বেড়েছে ১১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং সুদ পরিশোধে খরচ হয়েছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর মানে হচ্ছে, এই এক বছরের ব্যবধানে শুধু সুদ পরিশোধেই খরচ বেড়েছে ৭ হাজার কোটি টাকা। সবশেষ গত এক বছরে দেশে ডলারের দাম দুবার বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে এ সময়ে ডলারের বিপরীতে দেশীয় মুদ্রা টাকার মানের ৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ অবমূল্যায়ন ঘটেছে। বর্তমানে প্রতি ডলারে ১১৭ টাকা নির্ধারিত আছে। পূর্বাভাস আছে, আগামী অর্থবছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ এটি ১২৪ টাকা এবং জুন নাগাদ ১৩০ টাকায় ওঠে যাওয়ার। এ বাস্তবতায় সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগও ধারণা করছে, আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরও সরকারের বৈদেশিক সার্বিক দায়ে বৃদ্ধির প্রবণতা আরও বাড়তে পারে।
বর্তমানে দেশে অনেক মেগা প্রকল্প চালু রয়েছে। এর বাইরে আছে অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্প। এসব প্রকল্পের বেশিরভাগ উপকরণ এবং পরামর্শক ব্যয় আমদানিনির্ভর। আবার বাজেট ঘাটতি মেটাতে বিদেশ থেকে সরকার যে ঋণ নেয়, সেটিও নির্ধারিত কিস্তিতে সুদাসলে পরিশোধ হয়। আবার শুধু প্রকল্প ও ঋণজনিত দায় নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না সরকার, এর বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মাধ্যমে আমদানিকৃত পণ্য—সার, জ্বালানি ও খাদ্য এবং সেবার রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টির বিপরীতে প্রচ্ছন্ন দায়ও নিতে হয়। সব মিলিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকারের বৈদেশিক দায় পরিশোধের পারদ কতটা উচ্চতায় পৌঁছাবে, সেটি নির্ভর করছে এই ডলারের দামের গতিবিধির ওপর।
এদিকে অর্থ বিভাগের সামষ্টিক অর্থনীতি শাখার বিষয়ক একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, টাকার ১০ শতাংশ অবমূল্যায়নের ফলে চলতি অর্থবছর শেষে সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। এর বিপরীতে ১০ শতাংশ বাড়লে ঋণের পরিমাণ নেমে যাবে ৩৩৩ কোটি টাকায়। বাস্তবতা হলো, অর্থবছরের ১০ মাসেই বৈদেশিক দায়ের সুদাসল পরিশোধে ব্যয় হয়ে গেছে ৩০ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা। এর মানে হচ্ছে, বছর শেষে এই হিসাব সরকারের প্রাক্কলিত লক্ষ্যমাত্রা ৪০ হাজার ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
এই বাস্তবতায় আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতির আকার জিডিপির ৪.৬৭ শতাংশের মধ্যে রাখা হলেও বৈদেশিক ঋণ বা দায় পরিশোধের লক্ষ্য বাড়ানো হচ্ছে। এর পরিমাণ ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হতে পারে, যা অর্থবছর শেষে বাজেটে সম্ভাব্য বরাদ্দকৃত হিসাবকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে দেশের চাহিদাকৃত মূলধনি যন্ত্রপাতি, সব ধরনের কাঁচামাল এবং নিত্যপণ্য বেসরকারি উদ্যোগে আমদানি হয়ে থাকে। ডলারের দামে ঊর্ধ্বগতি চলতে থাকলে অতিরিক্ত ব্যয়ের দরুন দেশে আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে, যা বাজেটে সরকারের ৬ দশমিক ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির হার ধরে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে আমদানিজনিত এই অতিরিক্ত ব্যয়ের পারদ রিজার্ভে বড় রকমের চাপ তৈরি করবে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির সব ধরনের শৃঙ্খলাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।
বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের তথ্যানুযায়ী মার্কিন ডলারের বিপরীতে এক টাকা অবমূল্যায়নের ফলে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি প্রদানের পরিমাণ ৪৭৩ কোটি ৬০ লাখ টাকা বেড়ে যায়। একই সঙ্গে ভর্তুকির পাশাপাশি সরকারের প্রকল্পজনিত ব্যয় বাড়ে। ফলে দেশে টাকার যত অবমূল্যায়ন ঘটবে, প্রকল্পের ব্যয়ও তত বৃদ্ধি পাবে।
জানা গেছে, মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার দ্রুত অবমূল্যায়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশকে খাদ্য জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ বাড়িয়ে ৪০ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা করতে হয়েছিল। এই বরাদ্দ আরও বাড়িয়ে সংশোধিত বাজেটে সেটি ৫০ হাজার ৯২৬ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরও এ বাজেটে ভর্তুকি ৬৬ হাজার ৭৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়, যা বছর শেষে এ লক্ষ্যমাত্রাকেও অতিক্রম করতে পারে।
অন্যদিকে চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারি ও সরকারি গ্যারান্টিযুক্ত ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায় পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৬ হাজার ৬০০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি আর্থিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের দাম বাড়লে সরকারের সব ধরনের বৈদেশিক দায় পরিশোধের খরচ বাড়বে—সময়ের বাস্তবতা। কিন্তু এর থেকে শিক্ষা নেওয়ার অনেক বিষয় আছে। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত ব্যয় কমিয়ে আনতে হলে সবার আগে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। এটা বাড়ানো গেলে বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার হার কমে আসবে। যতটা সম্ভব স্থানীয়ভাবে পণ্য, সেবা ও প্রযুক্তির উৎপাদন ও মানবসম্পদের দক্ষতা বাড়ানোয় মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে প্রকল্পজনিত আমদানি ও পরামর্শক ব্যয় কমবে। সব মিলিয়ে এ ধরনের গুচ্ছ উদ্যোগ বাজেটে ঘাটতি কমাবে এবং সরকারকেও স্বস্তিতে রাখতে হবে। আমি মনে করি, এজন্য আর্থিক খাত ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কারই হলো শেষ কথা।