শেখ হারুন
প্রকাশ : ২৫ মে ২০২৪, ০৩:১২ এএম
আপডেট : ২৫ মে ২০২৪, ০৭:৪৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পাওনা সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা

অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পাওনা সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা

মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের শেষ জীবনের প্রত্যাশা অবসর ও কল্যাণ ভাতা। অবসরে গিয়েও বছরের পর বছর এই ভাতার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। শেষ জীবনে এসে অবসর সুবিধার টাকা না পেয়ে অনেক শিক্ষককে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এমনকি অনেকেই পেনশনের অর্থ না পেয়ে মৃত্যুবরণও করেন।

জানা গেছে, পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান না থাকায় যথাসময়ে শিক্ষকদের অবসর ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতি বছর এই খাতে শিক্ষকদের অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রতি বছরই বাড়ছে বিপুল অঙ্কের অর্থের ঘাটতি। সব মিলিয়ে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্ট বাবদ সরকারের কাছে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পাওনা জমেছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কল্যাণ ট্রাস্টে বছরে গড় আবেদন পাওয়া যায় ১৬ হাজার ৮০ থেকে ১৭ হাজার। এ ছাড়া বর্তমানে শিক্ষকদের ২৭ হাজার আবেদন ঝুলে আছে, যা নিষ্পন্ন করতে ৭২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমানে বছরে এই খাতে টাকার ঘাটতি আছে ১২০ কোটি, যে কারণে অনিষ্পন্ন আবেদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে এবং ক্রমাগতভাবে ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ ছাড়া, শিক্ষকদের অবসর সুবিধা বোর্ডে বছরে প্রায় ১০ হাজার ৮০০ আবেদন জমা হয়। আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করতে ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। বর্তমানে এখানে বছরে ঘাটতি ৪৪৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই খাত মিলিয়ে প্রতি বছর ঘাটতি থাকে ৫৭০ কোটি টাকা। ফলে প্রতি বছর অনেক আবেদন অনিষ্পন্ন অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এ মুহূর্তে এসব অনিষ্পন্ন আবেদন সম্পন্ন করতে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। কল্যাণ তহবিল এবং অবসর ভাতার ক্ষেত্রে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ক্রমাগতভাবে গ্যাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবসর ভাতা দ্রুত পরিশোধের জন্য এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ প্রয়োজন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ ভবনে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় বেসরকারি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের অনিষ্পন্ন আবেদনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এ ছাড়া বিদ্যমান জটিলতা স্থায়ীভাবে নিরসনের সব অংশীজনকে নিয়ে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শ দেওয়া হয়।

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে, অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্টের অনিষ্পন্ন আবেদনগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে একটি কার্যপত্র উপস্থাপন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান বলেন, সমস্ত অনিষ্পন্ন আবেদন সম্পন্ন করতে এই মুহূর্তে ৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা প্রয়োজন। এই বিশাল পরিমাণ টাকার সংস্থান কীভাবে করা যেতে পারে, সে বিষয়ে তিনি স্থায়ী কমিটির কাছে একটি নির্দেশনা চান।

কল্যাণ ট্রাস্টের সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, শিক্ষক কর্মচারীরা পূর্বে প্রাপ্ত বেতনের ২ শতাংশ হারে চাঁদা দিলেও কল্যাণ ও অবসর সুবিধা দিতে হচ্ছে নতুন পে-স্কেলের হিসাবে। যে কারণে কল্যাণ তহবিল এবং অবসর ভাতার ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হয়, যা বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় এ দুই খাতে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়ায় গ্যাপটা কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও ক্রমাগতভাবে গ্যাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবসর ভাতা দ্রুত পরিশোধের জন্য এই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের আহ্বান জানান তিনি।

অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, শিক্ষকদের চাঁদা এবং স্থায়ী আমানতের সুদ মিলে বছরে আসে প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় এখান থেকে বছরে ৫০-৫৫ কোটি টাকা পাওয়া যাবে; কিন্তু প্রতি বছর শিক্ষকদের দাবিকৃত অবসর ভাতা পরিশোধ করতে প্রয়োজন ৪৪৪ কোটি টাকা। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকারের অনুদান বৃদ্ধি প্রয়োজন।

স্থায়ী কমিটির সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, অবসর সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক সিডমানি হিসেবে প্রদত্ত অর্থ স্থায়ী আমানত হিসেবে রাখা হয়েছে। ওই স্থায়ী আমানত থেকে প্রাপ্ত সুদের একটি অংশ এই খাতে যোগ হয়। বর্তমানে ব্যাংকের সুদের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই স্থায়ী আমানতের সুবিধা যথাযথভাবে আদায় করে ঘাটতির পরিমাণ কমিয়ে আনার ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।

আরেক সদস্য মো. মোতাহার হোসেন বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষক ও কর্মচারীগণকে অবসরে গিয়ে বছরের পর বছর পেনশনের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি অনেকেই পেনশনের অর্থ না পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন, যা কোনোক্রমে কাম্য নয়। অর্থ সংকটের কারণে যথাসময়ে শিক্ষকদের অবসর ভাতা দেওয়া যাচ্ছে না। এটা সমাধানের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।

শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, অবসর সুবিধা প্রাপ্তির জন্য অনিষ্পন্ন আবেদন সংখ্যা অনেক বেশি হওয়ার একটা রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের এ সুবিধা দেওয়ার পর বিএনপি সরকার এই খাতে অর্থ বরাদ্দ না দিয়ে একটা বিশাল গ্যাপ তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালের বেতন স্কেলে বেতন-ভাতা শতভাগ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই খাতের ব্যয়ও বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পরও সরকার শিক্ষকদের সুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে সমস্যা সমাধানে আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, এই খাতে আয়ের চেয়ে ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় হজযাত্রী ও জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যায়ক্রমে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অবসর ভাতা পরিশোধ করা হচ্ছে। ফলে ক্রমাগত ঘাটতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদ্যমান জটিলতা স্থায়ীভাবে নিরসনে সব স্টেকহোল্ডারকে নিয়ে একটি কমিটি গঠনের পরামর্শ দেন তিনি।

ঘাটতি পূরণে বিভিন্ন প্রস্তাবনা: সভা সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ভাতার ঘাটতি পূরণে বেশ কিছু প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। বৈঠকে অবসর সুবিধা বোর্ডের সচিব অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ সাদী বলেন, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ২ কোটি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বছরে জনপ্রতি ১০০ টাকা, প্রতিটি পাবলিক পরীক্ষার সময় প্রতি ছাত্রের কাছ থেকে ১০০ টাকা, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর তহবিল থেকে বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ এই খাতে বরাদ্দ দিলে বিদ্যমান সংকটের স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারীদের পেনশন এককালীন পরিশোধ না করে সরকারি কর্মচারীদের মতো অর্ধেক এককালীন পরিশোধ এবং বাকিটা মাসিক পেনশন হিসেবে দেওয়া যায় কি না তা ভেবে দেখার অনুরোধ জানান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী শামসুন নাহার। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে অবসর ভাতা খাতে অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাব্য অন্যান্য উৎসের একটি তালিকা তৈরির প্রস্তাব দেন বাহাউদ্দিন নাছিম। এ বিষয়ে কমিটির আরেক সদস্য আহমদ হোসেন বলেন, যেহেতু এই সমস্যা দ্রুত সমাধানের কোনো সম্ভাবনা নেই, তাই শিক্ষকদের পেনশন এককালীন পরিশোধ না করে দুটি কিস্তিতে পরিশোধের বিধান করে অধিক সংখ্যক শিক্ষককে সুবিধা প্রদানের জন্য তিনি অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সভাপতি অধ্যক্ষ মো. বজলুর রহমান মিয়া কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার দায় রাষ্ট্রের। শিক্ষকদের নিজেদের সঞ্চয় ঠিকমতো না পাওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। শেষ জীবনে সময়মতো অবসর ভাতা না পেয়ে টাকার অভাবে অনেকের চিকিৎসা হয় না। অবসরে গিয়ে টাকার অপেক্ষায় থেকে অনেকের মারা যাওয়ার নজিরও রয়েছে। শিক্ষকদের অবসর ও কল্যাণ তহবিলের ঘাটতি পূরণে জাতীয় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি অবসর ও কল্যাণ তহবিলের সুবিধা প্রদানে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

টাঙ্গাইলে কুকুরের কামড়ে শিশুসহ আহত ২১

রবিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

বন্যা মোকাবিলা ও পুনর্বাসনে আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের বৈঠক

খুবিতে তৃতীয় নৈয়ায়িক ন্যাশনাল্সে চ্যাম্পিয়ন চবি

গণহত্যায় জড়িতদের বিচার দাবি সমমনা জোটের

সিলেট কারাগারেই চিকিৎসা চলছে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নানের

৬ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ : মাহফুজ

রায় দিয়ে ‘বাবার ট্রাস্টে’ টাকা নেন বিচারপতি

‘সাংবাদিকরা সমাজে মেডিয়েটরের ভূমিকা পালন করে থাকেন’

দুর্গাপূজায় সনাতনীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করবে বিএনপি : মাহবুবের শামীম

১০

নাসা স্পেস অ্যাপস প্রতিযোগিতায় ঢাকা বিভাগে চ্যাম্পিয়ন জবি

১১

ষড়যন্ত্র বানচালে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : প্রিন্স

১২

কার হাতে কত সোনার মজুত?

১৩

পিএসসির চাকরির পরীক্ষা নিয়ে সমন্বয়ক সারজিসের স্ট্যাটাস

১৪

যে কোনো সময় ইরানে হামলা চালাবে ইসরায়েল

১৫

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঢাকার শাখা ব্যবস্থাপক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

১৬

লন্ডন থেকে দেশে ফিরছেন টুকু

১৭

কলেজ অধ্যক্ষকে বাঁচাতে ৪০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি

১৮

প্রতিটি শহীদ পরিবারকে পাঁচ কোটি টাকা দেওয়া উচিত : মেজর হাফিজ

১৯

সংসদের মেয়াদ ৪ বছর চায় গণঅধিকার পরিষদ

২০
X