সরকারবিরোধী আন্দোলন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সাংগঠনিক অবস্থান শক্তিশালী করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। কেন্দ্রে থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে সক্রিয় করাই দলটির মূল লক্ষ্য। সেজন্য নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণসহ কেন্দ্রীয় কমিটিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হতে পারে। এর মধ্যে যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে নতুনদের আনা হতে পারে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে সাংগঠনিক শক্তি-দুর্বলতা বিশ্লেষণ করা হয়। তার ভিত্তিতে এরই মধ্যে সংগঠন ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত ১ মার্চ ছাত্রদলের আগের কমিটি ভেঙে মূল নেতৃত্বে নতুনদের আনা হয়। যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দলসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনেরও প্রস্তুতি চলছে। সেইসঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্য পদ পূরণ এবং নিষ্ক্রিয়দের বদলে নতুন মুখ নিয়ে আসারও চিন্তা চলছে। সার্বিকভাবে সংগঠনকে গতিশীল ও মাঠের আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করতেই এসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমেই বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো হবে। সেই লক্ষ্যে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড জোরদার করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে কর্মিসভা ও কাউন্সিল হচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ে নতুন নেতৃত্ব আসছে। সত্যিকারের ত্যাগী নেতাকর্মীরা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকবেন, যাতে আন্দোলন-সংগ্রাম নতুন করে বেগবান হয়। এসব নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা চলছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখনই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়ে যাবে—বিএনপির নীতিনির্ধারকরাও এমন ভাবছেন না। এজন্য জনগণকে সম্পৃক্ত করে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বলে মনে করেন তারা। সেই লক্ষ্য নিয়েই দলকে শক্তিশালী করার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনগুলো পুনর্গঠন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হবে। বিশেষ করে দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে ত্যাগী নেতাদের পদায়নের চিন্তাভাবনা চলছে। এসব পদের জন্য ছাত্রদলের সাবেক কিছু নেতার নাম শোনা যাচ্ছে। এর বাইরে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতেও নতুন কিছু মুখ আসতে পারে। সেখানেও কয়েকজন সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা স্থান পেতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ওই বছরের ৬ আগস্ট নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়। সেখানে ছাত্রদলের শতাধিক সাবেক নেতাসহ অনেক নতুন মুখ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতার পদোন্নতি হয়েছে। এ ছাড়া নতুন করে জায়গা পেয়েছেন বেশ কয়েকজন। তার পরও বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক পদ খালি রয়ে গেছে।
জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে বর্তমানে পাঁচটি পদ খালি আছে। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ১৭টি, উপদেষ্টা পরিষদের ১৭টি এবং সম্পাদক ও সহ-সম্পাদক মিলে একশর মতো পদ খালি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর মধ্যে আইন, যুব, জলবায়ু পরিবর্তন ও মহিলাবিষয়ক সম্পাদক এবং ছাত্রবিষয়ক, তথ্য ও গবেষণা এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক সহ-সম্পাদকের পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে যুব ও ছাত্রবিষয়ক সহ-সম্পাদকের দুটি পদ ৮ বছরেও পূর্ণ হয়নি। আর বাকিগুলো রদবদল, মৃত্যু, বহিষ্কার কিংবা পদত্যাগের কারণে শূন্য হয়েছে।
বিএনপি সূত্র জানায়, বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এখন আট থেকে ১০ জনের বেশি সদস্য উপস্থিত থাকেন না। নির্বাহী কমিটির অনেকে অসুস্থ ও বয়সজনিত কারণে নিষ্ক্রিয়। অনেকেই জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করায় কেন্দ্রে সময় দিতে পারেন না। আবার কেউ কেউ কেন্দ্রে থাকলে এলাকায় সময় দিতে পারেন না। ফলে নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ এবং ‘এক নেতার এক পদ’ নীতি কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে।
জানা গেছে, বিএনপির গত কাউন্সিলের পর থেকেই স্থায়ী কমিটিতে দুটি পদ খালি ছিল। পরবর্তী সময়ে এম কে আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, আ স ম হান্নান শাহ ও মওদুদ আহমদ মারা যান। এ ছাড়া সাবেক সেনাপ্রধান মাহবুবুর রহমান পদত্যাগ করেন। সব মিলিয়ে স্থায়ী কমিটিতে শূন্য পদের সংখ্যা সাতটিতে দাঁড়ায়। এর মধ্যে সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুকে স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফলে এখনো পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। আবার স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে খালেদা জিয়া ‘সাজাপ্রাপ্ত’ ও অসুস্থ হওয়ায় রাজনীতিতে ‘সক্রিয়’ নন। চিকিৎসাধীন থাকায় দলীয় কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছেন না ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। রফিকুল ইসলাম মিয়া দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। নব্বইয়ের বেশি বয়সী জমির উদ্দিন সরকার বৈঠকে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। বিদেশে অবস্থান করায় সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারছেন না ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। এ অবস্থায় সক্রিয় নেতাদের দিয়ে স্থায়ী কমিটির শূন্য পদ পূরণের জন্য দলের ভেতর দাবি উঠছে।
দলীয় সূত্র জানায়, জাতীয় নির্বাচনের আগে ধারাবাহিক আন্দোলনে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের ভূমিকা মূল্যায়ন করেছে বিএনপি। সেই আন্দোলনে সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় নেতাদের তালিকা ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে পাঠানো হয়েছে। সাংগঠনিক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ধাপে ধাপে দল পুনর্গঠন করবেন।
বিভিন্ন সূত্রে কথা বলে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির শূন্য পদের জন্য বেশ কয়েকজন নেতা আলোচনায় আছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দীন আহমদ, আব্দুল আউয়াল মিন্টু, বরকত উল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, জয়নুল আবেদিন, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। যুগ্ম মহাসচিব পদের জন্য আলোচনায় আছেন সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, আসাদুল হাবিব দুলু, প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, প্রশিক্ষণবিষয়ক সহ-সম্পাদক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সহ-সম্পাদক প্রকৌশলী আশরাফ উদ্দিন বকুলসহ কয়েকজন।
জানা গেছে, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক পদেও পরিবর্তন আনা হতে পারে। এই পদের জন্য আলোচনায় আছেন যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, কেন্দ্রীয় নেতা তাইফুল ইসলাম টিপু, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, আবদুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, এবিএম মোশাররফ হোসেন, জি কে গউছ, শহীদুল ইসলাম বাবুল, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আবদুল খালেক, মো. শরীফুল আলম ও অনিন্দ্য ইসলাম অমিত।
বিএনপির ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ‘তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে এবং জনগণকে সংগঠিত করতে সারা দেশে কর্মিসভা করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের কাছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।’
এদিকে বিএনপির পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোও মাঠ গোছানোর কাজ শুরু করেছে। সংগঠনকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে রাজশাহী বিভাগ থেকে কর্মিসভা শুরু করেছে ছাত্রদল। পর্যায়ক্রমে সব সাংগঠনিক জেলায় কর্মিসভা করা হবে জানান ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির। তিনি বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য জেলায় কর্মিসভা করা হবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ এবং বিভিন্ন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠনের কাজ চলমান।’
এ ছাড়া গত শনিবার নয়াপল্টনে জরুরি সভা করে সারা দেশে কর্মিসভার জন্য ১০টি বিভাগে ২৮টি সাংগঠনিক টিম গঠন করেছে জাতীয়তাবাদী কৃষক দল। সংগঠনটির সভাপতি হাসান জাফির তুহিন কালবেলাকে বলেন, ‘কৃষক দলকে সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে তৃণমূলে সফরের জন্য সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনেরও টিম করা হবে। এতে আবারও নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হবেন এবং মনোবল ফিরে পাবেন বলে আশা করছি।’
কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম বাবুল বলেন, ‘সারা দেশে নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া, দল শক্ত করা ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা নিরসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা শিগগিরই কাজ শুরু করবেন।’