দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকারের পদত্যাগ ও নতুন নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। নির্বাচনের চার মাস পর সরকারবিরোধী সেই আন্দোলনের কর্মকৌশল নির্ধারণে এবার যুগপতের শরিকদের সঙ্গে বসতে যাচ্ছে দলটির লিয়াজোঁ কমিটি। এর অংশ হিসেবে আজ রোববার থেকে মিত্রদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক শুরু করবে বিএনপি। দাবি আদায়ে আগামী দেড় থেকে দুই বছর মেয়াদি কোনো কর্মপরিকল্পনা নেওয়া যায় কি না অথবা কোন কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে ফেরা যায়, বৈঠকে সে ব্যাপারে শরিকদের মতামত নেবে বিএনপি।
বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের পর আনুষ্ঠানিক এই সিরিজ বৈঠকে শরিকদের থেকে প্রাপ্ত মতামতগুলো দলের স্থায়ী কমিটিতে পর্যালোচনা শেষে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। এর ফলে শিগগির যুগপৎ আন্দোলন মাঠে গড়াবে।
মিত্রদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক আয়োজন প্রসঙ্গে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, ‘বৈঠকের উদ্দেশ্য বহুবিধ। যুগপতের শরিক বন্ধুদের কাছ থেকে গত ২৮ অক্টোবর কিংবা ২৮ অক্টোবর কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরবর্তী কার্যক্রমগুলোর একটা মূল্যায়ন জানা এবং ভবিষ্যতে আন্দোলনের ইতিবাচক কর্মসূচি কী হতে পারে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা। এ ছাড়া শরিকদের পক্ষ থেকেও কিছু প্রস্তাবনা থাকতে পারে, আমাদের কাছে তাদের কিছু জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। সবকিছু মিলিয়েই তাদের সঙ্গে আবার আনুষ্ঠানিকভাবে বসা। যদিও মিত্রদের সঙ্গে আমাদের অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ আছে। এখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বসাটা আবার শুরু করছি।’
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বছরের অধিক কালব্যাপী রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। কিন্তু তাদের আন্দোলন ও বর্জনের মধ্যে গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন হয়। সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে নির্বাচনের আগে আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে ভোট বর্জনের ক্যাম্পেইন চালায় বিএনপি। দলটির দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ওই নির্বাচন বর্জন করে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির নৈতিক বিজয় এবং ক্ষমতাসীনদের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। তবে রাজপথের দীর্ঘ আন্দোলন সফল না হওয়ার কারণ অনুসন্ধানে দলীয়ভাবে পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন শুরু করে বিএনপি।
এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি থেকে যুগপতের শরিকদের সঙ্গে বিএনপির হাইকমান্ডের ভার্চুয়ালি সিরিজ বৈঠক হয়। যেটাকে বিএনপি ও শরিকদের পক্ষ থেকে ‘সৌজন্য বৈঠক’ বলা হয়েছিল। সেখানে সরকারি নানামুখী চাপ ও প্রলোভন সত্ত্বেও নির্বাচনে না যাওয়া এবং যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহত রাখায় মিত্রদের সাধুবাদ জানানো হয়। তবে সৌজন্য বৈঠক হলেও সেখানে আন্দোলনের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে কম-বেশি আলোচনা হয়। ভবিষ্যতের স্বার্থে বিএনপিকে বিগত আন্দোলন ঠিক কী কারণে ব্যর্থ হলো, তার একটা যথাযথ মূল্যায়নের পরামর্শ দেয় গণতন্ত্র মঞ্চ।
এদিকে নির্বাচনের পর বিএনপি দলীয়ভাবে থেমে থেমে ইস্যুভিত্তিক কিছু কর্মসূচি করলেও যুগপতভাবে কোনো কর্মসূচি মাঠে গড়ায়নি। কারণ, বিএনপির কাছে তখন দলের কারাবন্দি নেতাদের জামিনে মুক্তির বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তা ছাড়া দীর্ঘ আন্দোলনের পর ‘ক্লান্ত ও বিপর্যস্ত’ নেতাকর্মীদের বিশ্রাম দেওয়াও ছিল দলটির লক্ষ্য। নির্বাচনের পর থেকে নেতাকর্মীরাও একে একে জামিনে মুক্ত হতে থাকেন। এরপর রমজানে ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে সংগঠনের হতাশাগ্রস্ত তৃণমূল ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয় বিএনপি। এ লক্ষ্যে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল সারা দেশে পাঁচ শতাধিক ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা হয়। ইফতার মাহফিলগুলোয় দলীয় নির্দেশনা অনুযায়ী কারামুক্ত নেতাকর্মীদের ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের চাঙ্গা ও উজ্জীবিত করতে অনেক ইফতার মাহফিলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন।
বিএনপির দাবি, ইফতার মাহফিল ঘিরে দলীয় নানামুখী কর্মকাণ্ডে সংগঠনের তৃণমূল ও নেতাকর্মীরা হতাশা কাটিয়ে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। তা ছাড়া কারাবন্দি প্রায় সব নেতাই জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত নেতারাও আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনে মুক্তি পাচ্ছেন। এরই মধ্যে বিএনপির তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান, ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসানসহ অনেকেই কারামুক্ত হয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে নতুন করে আন্দোলন শুরু করার চিন্তাভাবনা করছে বিএনপি।
ঢাকায় গত দুদিন দলীয়ভাবে ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ নবীসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে গত শুক্রবার নয়াপল্টনে সমাবেশ করেছে দক্ষিণ বিএনপি। এ ছাড়া খালেদা জিয়া ও যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুসহ কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবিতে গতকাল শনিবার একই স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে যুবদল। এখন মূল ইস্যু তথা নতুন নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার কথা ভাবছে বিএনপি। তা ছাড়া বিএনপির ওপর শরিকদের পক্ষ থেকেও কর্মসূচির চাপ রয়েছে। এতে করে নতুন কর্মসূচি নির্ধারণে মিত্রদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক ডেকেছে দলটি।
জানা গেছে, আজ প্রথম দিনে ১২ দলীয় জোট ও এলডিপির সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি। এদিন বিকেল ৩টায় ১২ দল এবং বিকেল ৪টায় কর্নেল (অব.) অলি আহমদের দলের সঙ্গে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া আগামীকাল সোমবার প্রথমে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট এবং পরে লেবার পার্টির সঙ্গে বিএনপির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। পর্যায়ক্রমে শরিক সব দল ও জোটের মতামত নেবে বিএনপি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এসব বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বৈঠক প্রসঙ্গে ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর বিএনপি ও ১২ দলীয় জোটের লিয়াজোঁ কমিটির মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অতীতের আন্দোলনে কোনো ভুল-ত্রুটি থাকলে সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। পাশাপাশি আগামীতে কী ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, বৈঠকে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’