ছোট্ট পতঙ্গ মশা মাঝেমধ্যে ভয়ংকর হয়ে ওঠে। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে রয়েছে মশা। মশাই একমাত্র প্রাণী, যে পৃথিবীতে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। বিবিসির তথ্যমতে, প্রতি বছর পৃথিবীতে ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জিকা ইয়েলো ফিভার, ওয়েস্টনাইল ফিভার অন্যতম। এই মুহূর্তে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে সতর্কবার্তা জারি করেছে। সংস্থাটি হুঁশিয়ারি করেছে যে, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ ডেঙ্গু ঝুঁকিতে রয়েছে। গত বছর পৃথিবীর প্রায় ১৩০টি দেশে ডেঙ্গু সংক্রমণ হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ব্রাজিল, বলিভিয়া, আর্জেন্টিনা, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ।
উষ্ণ-আর্দ্র আবহাওয়া, বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বজ্র ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে না করতে পারায় ধীরে ধীরে মশার স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। কয়েকদিন ধরে মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। বর্তমান সময়ে যে মশাগুলো আমরা দেখছি, এর প্রায় ৯৮ শতাংশ কিউলেক্স মশা। এই মশা ডেঙ্গু রোগের বাহক নয়। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যায় বর্ষা মৌসুমে। তবে এখন যে এডিস মশা নেই, তা কিন্তু নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় গবেষণা করতে গিয়ে শীতকালেও আমরা ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা পাচ্ছি। শীতকালে যখন বৃষ্টিপাত থাকে না তখনো নির্মাণাধীন ভবনের নিচে, বহুতল ভবনের বেজমেন্টে জমা পানি এবং মানুষের বাসাবাড়িতে ড্রাম-বালতিতে জমিয়ে রাখা পানিতে এডিস মশার সফল প্রজনন লক্ষ করা যাচ্ছে।
বছরের শুরু থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু। জানুয়ারি থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জানুয়ারি থেকে মে মাসের গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার ৩৯১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মৃত্যু হয়েছে ২৯ জনের। এমন পরিস্থিতিতে বছরের শুরু থেকেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি করপোরেশন সতর্ক অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় চেষ্টা করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বাংলাদেশ স্কাউটস, বিএনসিসি এবং স্কুল ছাত্রছাত্রীদের এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশ স্কাউটস এবং বিএনসিসি সদস্যদের এ কাজে যোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে তারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। যেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। বিভিন্ন সেবামূলক সংস্থা এবং স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হলে অবশ্যই ভালো ফল আসবে। তাদের এই কার্যক্রম নিয়মিতভাবে মনিটর করতে হবে। অনেক ভালো উদ্যোগও মনিটরিংয়ের অভাবে বিফলে যেতে পারে।
বাংলাদেশে ১৯৬৪ সালে ডেঙ্গু আসে, তখন এটিকে ঢাকা ফিভার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাব মতে, ৫ হাজার ৫০০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। বাংলাদেশে ডেঙ্গু বড় ধরনের আঘাত হানে ২০১৯ সালে। এ বছর প্রায় ১,০১,৩৫৪ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং সারা দেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬২ হাজার ৩২১ ও ২৮১ জন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ২০২৩ সালে। এ বছর ৩ লাখ ২১ হাজারের অধিক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ আক্রান্ত ২০২৩ সালে হলেও ওই বছরের এই সময়ে আক্রান্ত ছিল ৯০০-এর কম। বাংলাদেশের ইতিহাস ভেঙে দেওয়া ডেঙ্গু আক্রান্তের বছরের হিসাবকে ছাড়িয়ে ২০২৪ সালের শুরু থেকে আগ্রাসী ভূমিকায় আছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্য মতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলা শহরে ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের গবেষণায়ও আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলায় ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব পাচ্ছি। দীর্ঘদিন মশা নিয়ে গবেষণা করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি যে ফোরকাস্টিং মডেলটি তৈরি করি, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, এ বছর ডেঙ্গু বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করবে বাংলাদেশকে। ঢাকা ছাড়াও ঢাকার বাইরের কিছু জেলায় বিগত বছরগুলোর সব হিসাব অতিক্রম করে ডেঙ্গু আঘাত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, বরিশাল, বরগুনা, কক্সবাজার, চাঁদপুর, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও খুলনায় ডেঙ্গুর ব্যাপক সংক্রমণ হতে পারে। এই জেলাগুলো ছাড়াও বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটবে চলতি বছরে।
ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। আর এটিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণও সহজ, কারণ এডিস মশা পাত্রে জমা পানিতে বংশ বিস্তার করে। জমা পানির পাত্র অপসারণ কঠিন কোনো কাজ নয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি নগরবাসীকেও সম্পৃক্ত হতে হবে। অন্যান্য মশার চেয়ে এডিস মশা কীটনাশক সহনশীল, তাই কীটনাশক দিয়েও এটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ।
মে মাসের ডেঙ্গুর পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরও বৃদ্ধি পাবে। এ বছর ডেঙ্গুর মৌসুমে বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু ভয়াবহ হতে পারে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগাম পদক্ষেপ নিতে হবে। এই আগাম পদক্ষেপের অন্যতম হলো এডিস মশার প্রজননস্থল অপসারণ বা নিয়ন্ত্রণ করা। যখন বৃষ্টিপাত বাড়তে শুরু করবে, তখন থেকেই এডিস মশার প্রজনন বৃদ্ধি পেতে থাকবে। বৃষ্টি হলে বাড়ি, বাড়ির আঙিনা অথবা বিভিন্ন জায়গায় আনাচকানাচে পড়ে থাকা পাত্রে পানি জমা হবে এবং সেই পানিতে এডিস মশা ডিম পেড়ে তার বংশ বিস্তার করবে। কোনো একটি জায়গায় এডিস মশার ঘনত্বের ইনডেক্স বা ব্রোটো ইনডেক্স যখন ২০ অতিক্রম করবে, তখনই সেই এলাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পেতে থাকবে। মৌসুমের শুরুতে পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের কার্যক্রম সঠিকভাবে করতে পারলে এটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণের অভিভাবক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান; সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৌসুমের শুরুতেই ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সেটি বাস্তবায়নের জন্য সঠিক দিকনির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন। যেসব সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণবিষয়ক প্রশিক্ষিত জনবল নেই, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সঙ্গে সঙ্গে মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক কীটনাশক বাছাই করে তা সরবরাহ করা গুরুত্বপূর্ণ। কোন কীটনাশক কোন ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে সঠিক মাত্রায় সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করতে হবে, তার প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেওয়া দরকার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও জনসাধারণকেও সতর্ক অবস্থায় থেকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
এই মুহূর্তে ডেঙ্গু ছোট ছোট বিভিন্ন পকেট স্থানে রয়েছে। বর্তমান সময়ে যেসব বাড়িতে ডেঙ্গু হচ্ছে সেই বাড়িকে কেন্দ্র করে ৫০০ মিটারের মধ্যে এডিস মশা নিশ্চিতভাবে মেরে দিতে হবে। কারণ এরা বেঁচে থাকলে বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই জায়গাগুলো থেকে বিস্তৃত হয়ে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে। বৃষ্টির মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানভিত্তিক প্রয়োগ ঘটাতে পারলে ডেঙ্গুকে এ বছর নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে রাখা সম্ভব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা সফলভাবে করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কর্মরত ডাক্তার এবং নার্সদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
ডেঙ্গু এমন একটি সমস্যা, যেটিকে সরকার বা সিটি করপোরেশন একা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই জনগণের সম্পৃক্ততা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়নি। ডেঙ্গু সংক্রমণ পরিস্থিতিতে কাউকে দোষারোপ না করে যার যার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে মশা নিয়ন্ত্রণে সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব রাস্তাঘাট, উন্মুক্ত স্থান, সরকারি স্থাপনা, বাস টার্মিনালগুলোতে এডিস মশার প্রজনন বন্ধ ও নিয়ন্ত্রণ করা, আর নগরবাসীর দায়িত্ব তার বাড়ি এবং আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয়, তা নিশ্চিত করা। আমরা গত বছরের ভয়ংকর ডেঙ্গু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাই না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এখনই ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করুক স্থানীয় সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কার্যক্রম শুরু করতে পারে। জনগণকেও যে যার অবস্থান থেকে নিজ নিজ বাড়ি ও বাড়ির আঙিনায় এডিস মশার প্রজনন যেন না হয়, সেটিকে নিশ্চিত করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে সঠিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারলে নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে থাকবে ডেঙ্গু।
লেখক: কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক এবং অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়