পথেঘাটে পড়ে থাকা অসুস্থ মানুষকে তুলে নিতেন নিজের ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের আশ্রমে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টিমের সদস্যদের দিয়ে মানবিক ভিডিও তৈরি করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতেন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। এরপর এ ধরনের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানাতেন তিনি। মানবিক কারণে তার কাছে দেশ-বিদেশ থেকে টাকা পাঠাতেন লোকজন। সেই দানের টাকার অংশ দিয়েই নিয়মিত মাদক সেবন করতেন মিল্টন সমাদ্দার। এ ছাড়া তার নানা প্রতারণা আর অপকর্মের তথ্য পাচ্ছেন গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে মিলেছে এই তথ্য।
এদিকে মিল্টন সমাদ্দারের স্ত্রী মিঠু হাওলাদারও গোয়েন্দা জেরার মুখে পড়তে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিবি। আজ রোববার তাকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে। ডিবি সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে মিঠু হাওলাদারের দেওয়া তথ্যে গরমিল পেলে তাকেও আইনের আওতায় নেওয়া হতে পারে।
গত ২৫ এপ্রিল কালবেলায় ‘মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দার’ এবং ‘জীবনের ধাপে ধাপে প্রতারণা’ শিরোনামে দুটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। এর পরই মানবিকতার আড়ালে ভয়ংকর মুখোশ পরা মিল্টন সমাদ্দারের আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। একের পর এক ভয়ংকর প্রতারণা আর অপকর্মের তথ্য পাওয়ার পর গত বুধবার রাতে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তাকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের হেফাজতে নেয়। রিমান্ডে মিল্টন সমাদ্দারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে চমকে যাচ্ছেন গোয়েন্দারাও।
ডিবি সূত্র জানায়, মিল্টন সমাদ্দারের ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামে প্রতিষ্ঠানে রাখা অনেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী তা নিকটস্থ থানায় জানানো হয়নি। শুধু নিজের প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসক মাহিদ খানের স্বাক্ষরে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে লাশ দাফন করা হতো। কিন্তু সেই চিকিৎসকেরও স্বাক্ষর জাল করতেন মিল্টন সমাদ্দার।
মিল্টনকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ডিবির এক কর্মকর্তা জানান, তারা সেই চিকিৎসককেও ডেকে জেরা করেছেন। ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিল্টন সমাদ্দারের ‘মানবিক’ কাজ থেকে তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। মানবিক কারণেই মিল্টন সমাদ্দারের প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। কোনো বেতনও নিতেন না, খুব বেশি যেতেনও না। কিন্তু আশ্রমের বাসিন্দাদের মৃত্যুর পর তার স্বাক্ষরে সনদ দেওয়া হলেও কোনো স্বাক্ষরই তার নয়। মিল্টন সমাদ্দারের বিষয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন হওয়ার পর জানতে পারেন, তার স্বাক্ষরে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছে! পরে বুঝতে পারেন, মিল্টন সমাদ্দার তার স্বাক্ষর জাল করেছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানিয়েছেন, মিল্টন সমাদ্দার রিমান্ডে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আশ্রমের বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে মিল্টনের স্ত্রীকে ডিবিতে ডাকা হয়েছে। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
ডিবিপ্রধান হারুন বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ সেসব বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। নিজের বাবাকে পিটিয়ে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় এসে মিল্টন সমাদ্দার সাইকোতে (উন্মাদ) পরিণত হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এসেছে সেসব বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, তার কীভাবে উত্থান হলো, তথাকথিত মানবতার ফেরিওয়ালা কীভাবে হলেন, তার অর্থের উৎস কী, কীভাবে তিনি দরিদ্র মানুষদের সংগ্রহ করতেন এবং কেনই বা তাদের টর্চার সেলে এনে পেটাতেন—সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে মিল্টন কীভাবে অর্থ উপার্জন করতেন এবং কারা তাকে সহায়তা করতেন—তাদেরও শনাক্ত করে প্রয়োজনে তথ্য নেওয়া হবে জানিয়ে অতিরিক্ত কমিশনার হারুন বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের তিন-চারটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে। সেসব অ্যাকাউন্টে কারা টাকা পাঠাতেন, তদন্ত করে জানানো হবে।