জুনায়েদ শিশির
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৩, ০৭:৫৯ এএম
আপডেট : ১১ জুন ২০২৩, ১০:৫০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কৃষিযন্ত্রে ‘কুমির’ চুরি

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সরকারের ভর্তুকির টাকায় ফসল কাটার যন্ত্র বা হারভেস্টার কেনা নিয়ে চলছে হরিলুটের কারবার। প্রকল্প শুরুর পর থেকে দেড় বছরে বাস্তবে যত যন্ত্র আমদানি করা হয়েছে, কাগজে-কলমে তার চেয়ে ৮৮৩টি বেশি দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে ৪২৮টির বিপরীতে নগদ সহায়তার টাকা তুলে নিয়েছে সরবরাহকারীরা। চতুর শেয়াল আর বোকা কুমিরের গল্পের কুমির ছানার মতো একই যন্ত্র একাধিকবার দেখিয়ে তুলে নেয়া হয়েছে এই টাকা। ভর্তুকির টাকা তুলে নিয়েছে তারা। এ জালিয়াতির ফলে সরকারের ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৬৭ কোটি ৫২ লাখ টাকা। প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট নথি এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাব পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, পাঁচ বছরমেয়াদি ‘সমন্বিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ’ প্রকল্পে কৃষকদের জন্য ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার বেশি ভর্তুকি সহায়তা দিচ্ছে সরকার। কৃষি মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এর মাধ্যমে কৃষকদের কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার, মেইজ শেলার, পাওয়ার থ্রেশার, সিডার, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারসহ চাষাবাদের আধুনিক বিভিন্ন যন্ত্র সরবরাহ করে। যন্ত্রের মোট দামের একাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে পরিশোধ করে। বাকি টাকা কৃষক বা কৃষি উদ্যোক্তাকে দিতে হয়।

প্রকল্প পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, এ প্রকল্পে ১৫ হাজার হারভেস্টার সরবরাহের সিদ্ধান্ত রয়েছে। প্রকল্পের শুরু থেকে মাঠপর্যায়ে ৯ হাজার হারভেস্টার কৃষকদের কাছে দেওয়া হয়েছে। অন্য যন্ত্রপাতিসহ এ প্রকল্পের আওতায় সরবরাহ যন্ত্রের সংখ্যা ২৮ হাজার ছাড়িয়েছে। প্রকল্পের আওতায় কৃষক বা কৃষি সমিতি ফসল কাটার যন্ত্র (কম্বাইন্ড হারভেস্টার) কিনলে মোট দামের অর্ধেক ভর্তুকি দেয় সরকার। হাওর ও উপকূলীয় অঞ্চলে ভর্তুকির এ হার ৭০ শতাংশ। সরকার নির্ধারিত ১৪টি কোম্পানি কৃষকের কাছে ফসল কাটার (হারভেস্টার) যন্ত্র সরবরাহ করছে। এর মধ্যে একটি ছাড়া বাকি সব বিদেশ থেকে আমদানি করে এসব যন্ত্র সরবরাহ করছে। বর্তমানে প্রতিটি যন্ত্রের বিপরীতে এলাকাভেদে ভর্তুকির পরিমাণ ১৫ লাখ ৭৫ হাজার থেকে ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

স্মার্ট কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রমিক সংকট, বাড়তি মজুরি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রমঘণ্টা ও উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে ২০২০ সালে এ প্রকল্প চালু করা হয়; কিন্তু অনিয়ম, দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাবে সরকারের এ ইতিবাচক উদ্যোগ অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ কিছু কোম্পানি টেকসই হারভেস্টার আমদানি না করে চীন থেকে কম দামে কিনে তা সরবরাহ করে কৃষক ও প্রকল্পের ভর্তুকির টাকা তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে ফসল কাটার মৌসুমে যন্ত্র সচল না থাকায় লোকসানে পড়ে কোম্পানির ঋণের জালে আটকা পড়ছেন সাধারণ উদ্যোক্তারা। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে সে সুযোগে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অপমান-অপদস্থ করে যন্ত্রটি নিয়ে যাচ্ছে কোম্পানির লোকেরা। এরপর একই যন্ত্র অন্য কৃষকের কাছে বিক্রি করে সরকারের কাছ থেকে আরেক দফা ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। যন্ত্র সরবরাহকারী কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভুয়া কৃষি উদ্যোক্তা দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তুলে নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যন্ত্র সরবরাহের দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৪ কোম্পানির বেশিরভাগেরই আগে কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সরকারের ভর্তুকিতে কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ শুরুর পর এ প্রকল্পকে কেন্দ্র করেই এসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়। কৃষিযন্ত্র আমদানি ও বিপণনের পূর্ব অভিজ্ঞতাসহ প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ছাড়াই দায়িত্ব পেয়েছে কোনো কোনো কোম্পানি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক ব্যবসায়ী জানান, কৃষি খাতের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও তদবিরের জোরে কাজ দেওয়া হয়েছে। তারা মাঠপর্যায়ে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। বিল তুলে নিচ্ছে। অন্যদিকে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা প্রকল্প কর্তাব্যক্তিদের কাছে পাত্তা পাচ্ছে না। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যমতে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে ৭ হাজার ১০৬টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার আমদানি করেছে; কিন্তু কৃষকের কাছে সরবরাহ এবং বর্তমান মজুত মিলিয়ে যন্ত্রের হিসাব দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৮৯টি। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানির অতিরিক্ত ৮৮৩টি যন্ত্র সরবরাহ করা হয়েছে।

১৪টি কোম্পানির মধ্যে ৫টির ক্ষেত্রে আমদানি ও সরবরাহের হিসাবে গরমিল পাওয়া গেছে। অনিয়মে জড়িত কোম্পানিগুলো হলো—আদি এন্টারপ্রাইজ, আলীম ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, বাংলামার্ক করপোরেশন এবং উত্তরণ ইঞ্জিনিয়ারিং। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আড়াই বছরে এ পাঁচটি কোম্পানি সব মিলিয়ে ১ হাজার ৩৩৭টি ফসল কাটার যন্ত্র আমদানি করেছে। আর প্রকল্পের তথ্য বলছে, এখন পর্যন্ত কৃষকের কাছে ১ হাজার ৭৬৬টি যন্ত্র সরবরাহ দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তু্লে নিয়েছে এসব কোম্পানি। সব মিলিয়ে বাড়তি ভর্তুকি বিলের সংখ্যা ৪২৯টি। এরপরও এ পাঁচ কোম্পানির কাছে কম্বাইন্ড হারভেস্টার মজুত আছে ৪৫৪টি। নথিপত্র বলছে, প্রকল্প শুরু থেকে গত আড়াই বছরে আদি এন্টারপ্রাইজ ১২৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার আমদানি করে। অথচ ভর্তুকির জন্য প্রতিষ্ঠানটির নামে বিল করা হয় ১৫৬টি যন্ত্রের। সেই সময়ে তাদের কাছে আরও ৪৯টি যন্ত্র মজুত দেখানো হয়। সরবরাহ ও মজুত মিলিয়ে আমদানির তুলনায় আদি এন্টারপ্রাইজের ৭৭টি যন্ত্র অতিরিক্ত দেখানো হয়েছে। একইভাবে আলীম ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ১৫০টি, এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ২৫১টি, বাংলামার্ক করপোরেশন ৩৬০টি, উত্তরণ ইঞ্জিনিয়ারিং ৪৫টি অতিরিক্ত যন্ত্রের হিসাব দিয়েছে।

যন্ত্র আমদানির চেয়ে বেশি সরবরাহের বিষয়ে জানতে চাইলে আলীম ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ কৃষি যন্ত্রপাতি প্রস্তুতকারক সমিতির সভাপতি আলীম এহসান কালবেলাকে বলেন, ‘হারভেস্টার সরবরাহ না করে বিল তোলার সুযোগ নেই। অতিরিক্ত বিল কোথা থেকে নেব। আগের বোরো মৌসুমের বিলই এখন পর্যন্ত পাচ্ছি না।’

তিনি বলেন, ‘আমি প্রকল্পের পরীক্ষামূলক (পাইলট) থেকে কাজ করছি। এখন বড় পরিসরে ব্যাপকভাবে কাজ চলছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, যাদের এ শিল্পের অভিজ্ঞতা নেই, তারা চলে এসেছেন। যে কারণে বিভিন্ন কথা উঠেছে। আমরা যারা পুরোনো, তারা ক্রেতাদের ছেড়ে যেতে পারব না। আমাদের ব্যবসা করে খেতে হবে। দেখা যাবে প্রকল্প মেয়াদ শেষ হলে অনেককে খুঁজে পাওয়া যাবে না।’

এসকিউ ট্রেডিং অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের ডিরেক্টর (ফিন্যান্স) মাহবুবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘এসব অভিযোগ অবাস্তব। আপনার এমন প্রশ্নে অপমান বোধ করছি। এসব অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ফসল কাটার যন্ত্র সরবরাহে নানাভাবে জালিয়াতি করা হয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান যন্ত্র আমদানি না করেই ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে কৃষকের কাছে বিক্রি দেখিয়ে ভর্তুকির টাকা তু্লে নিয়েছে। আবার একই যন্ত্র একাধিকবার বিক্রি করে তার বিপরীতে ভর্তুকি নেওয়া হয়েছে। এ ধরনের ভুয়া বিল ভাউচার তৈরির ক্ষেত্রে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যন্ত্র সরবরাহের পর কোম্পানিগুলো সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমা দিয়ে প্রকল্প থেকে ভর্তুকির টাকা তুলে নেয়। অন্যদিকে অনেক এলাকায় কৃষক বা উদ্যোক্তার কাছ থেকে তার অংশের টাকা নেওয়া হয় কিস্তিতে। অনেক কৃষকই নানা কারণে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সরবরাহ করা যন্ত্র নিম্নমানের হওয়ায় ফসল কাটার মৌসুমে বারবার নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে উদ্যোক্তারা সময়মতো কৃষকের জমির ফসল কাটতে পারেন না। কাঙ্ক্ষিত আয় না হওয়ায় তাদের পক্ষে কিস্তির টাকা পরিশোধ করা সম্ভব হয় না। এভাবে কিস্তি দিতে না পারায় এক সময় সরবরাহকারী কোম্পানির লোকজন কৃষক বা উদ্যোক্তার কাছ থেকে যন্ত্রটি ফেরত নিয়ে যান। ওই যন্ত্রটি আবার অন্য এলাকার কোনো কৃষকের কাছে বিক্রি করা হয়। এভাবে একই যন্ত্র দুবার বিক্রি দেখিয়ে প্রকল্প থেকে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হয়। এ কারণেই প্রকৃত আমদানি ও সরবরাহের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল তৈরি হয়েছে।

আদি এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কিনেছেন ভোলার লালমোহন উপজেলার মো. শাহিন। গত বছর বোরো মৌসুমে ধান কাটার শুরুর ঠিক আগে যন্ত্রটি বাড়ি নিয়ে আসেন; কিন্তু এর পরপরই এটি নষ্ট হয়ে যায়, যা ঠিক করতে করতে মোটামুটি ধান কাটা শেষ পর্যায়ে চলে আসে। এরপর ঠিকঠাক করে আমন মৌসুমে ধান কাটার জন্য মানিকগঞ্জ যান। মানিকগঞ্জে ধান কাটতে কাটতে আবারও মেশিন বন্ধ হয়ে যায়। কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এটি ঠিক করতে হলে ১ লাখ টাকা লাগবে বলে শাহিনকে জানানো হয়। সেই মুহূর্তে এত টাকা দেওয়ার সক্ষমতা না থাকায় সেটি আর ঠিক করা হয়নি। তখন থেকেই যন্ত্রটি পড়ে আছে।

মো. শাহিন বলেন, ‘প্রায় ২৯ লাখ টাকার যন্ত্রটি কিনতে ৭০ ভাগ ভর্তুকি দিয়েছিল সরকার; কিন্তু নষ্ট হয়ে পড়ে থাকায় এটি দিয়ে কোনো আয় করা সম্ভব হচ্ছে না। কোম্পানির কিস্তিও পরিশোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এ যন্ত্র এখন আমাদের জন্য বোঝা।’

যন্ত্রের ব্যয় টানতে না পেরে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক এতিব্বর মণ্ডল নিজের হারভেস্টারটি বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি জানান, ২০২০ সালের শেষে সাড়ে ২৯ লাখ টাকায় এসিআইর ইয়ানমার ব্র্যান্ডের একটি হারভেস্টার কেনেন। সরকারের ভর্তুকি সহায়তা বাদে তার নিজের খরচ দাঁড়ায় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। ৪ লাখ টাকা ডাউনপেমেন্ট দেওয়ার পর এ যন্ত্র দিয়ে আয় করে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা একটি কিস্তি দিয়েছিলেন; কিন্তু বছর না ঘুরতেই যন্ত্রটি বারবার নষ্ট হতে শুরু করে। প্রচুর টাকা খরচ হতে থাকলে তিনি মেশিনটি আর টানতে পারছিলেন না। তখন রাজশাহী সদরের একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়ে মুক্ত হন।

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার মো. মনোয়ারুল ইসলাম ২৮ লাখ টাকা দিয়ে এসিআইর ইয়ানমার ব্র্যান্ডের কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনেন ২০২০ সালের শেষদিকে; কিন্তু যন্ত্রটি বাড়িতে আনার পর থেকে ঠিকভাবে কাজ করছিল না। যে কারণে এসিআই যন্ত্রটি ১৫ দিনের মধ্যেই ফেরত নিয়ে নেয়; কিন্তু এর রিপ্লেসমেন্টে নতুন যন্ত্র দিতে সময় নেয় প্রায় এক বছর। এখনো কিস্তির পুরো টাকা শোধ হয়নি, এর মধ্যে যা আয় হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি খরচ হচ্ছে যন্ত্র ঠিকঠাক করতে।

একই অবস্থা বগুড়ার কৃষক আখতারুজ্জামানের। তিনি ২০২১ সালে ৩০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দামের একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনেন, যেখানে সরকারের ভর্তুকি সহায়তা বাদে তার নিজের খরচ পড়ে সাড়ে ১৬ লাখ টাকা। ৫ লাখ টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে কিস্তির মাধ্যমে আবেদীন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেডের এ মেশিনটি কেনেন; কিন্তু এটি কেনার পর থেকেই এত বেশি পরিমাণে নষ্ট হতে শুরু করে এবং পার্টস বদলানোর প্রয়োজন পড়তে থাকে, তাতে করে আড়াই বছরেও তিনি কিস্তি শোধ করতে পারেননি।

রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক মমিন সরকার এবং আরও দুজন কৃষক মিলে এসিআইর ইয়ানমার ব্র্যান্ডের দুটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনেন। প্রতিটির দাম ধরা হয় ২৯ লাখ ৫০ হাজার করে। প্রতিটির ভর্তুকি সহায়তা বাদে তাদের দিতে হয় সাড়ে ১৫ লাখ টাকা করে; কিন্তু ২০২২ সাল পর্যন্ত ডাউনপেমেন্ট ও কিস্তি বাবদ দুটি গাড়ির বিপরীতে এ তিন কৃষক ১৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন; কিন্তু শেষদিকে এসে বারবার নষ্ট হয়ে যাওয়ায় আয় বন্ধ হয়ে যায়। তখন কিস্তি দিতে না পারায় কোম্পানি এসে গাড়ি দুটি নিয়ে যায়।

এভাবে সরবরাহকারী প্রতিটি কোম্পানিই সারা দেশ থেকে যন্ত্র তুলে নিলেও তার বিপরীতে নেওয়া ভর্তুকির টাকা ফেরত দিচ্ছে না। আবার এ যন্ত্রটিই সার্ভিসিং করে ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন ও রংচং করে ফের দেশের অন্য কোনো প্রান্তে বিক্রি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নেত্রকোনার মদন উপজেলার কৃষক আবদুল কাদের গত বছর আদি এন্টারপ্রাইজের কম্বাইন্ড হারভেস্টার কেনেন সরকারি ভর্তুকি সহায়তায়। ২৮ লাখ টাকার এ গাড়িতে সরকারের ভর্তুকি ৭০ ভাগ। বাকি টাকার মধ্য ৫ লাখ ৩০ হাজার টাকা ডাউনপেমেন্ট দিয়ে হারভেস্টার কেনেন আবদুল কাদের। ২১১২৫৫১ চেসিস নম্বরের গাড়িটি বাড়িতে নিয়ে আসার পর মিটার দেখে বুঝতে পারেন, এটি ১৯৩ ঘণ্টা চালানো হয়েছে। পুরোনো এ যন্ত্রটি নিয়ে তিনি পড়েন আরও বিপাকে। নিয়ম করে এটা-ওটা নষ্ট হতে থাকে যন্ত্রটির। যন্ত্র দিয়ে এক বছরে তিনি ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা আয় করলে এর পেছনে ব্যয় হয়েছে ২ লাখ টাকার বেশি; কিন্তু এখন পুরোপুরি নষ্ট হয়ে আছে যন্ত্রটি।

তিনি বলেন, ‘যন্ত্রটি এখন পুরোপুরি নষ্ট, কোম্পানিকে ফোন দিয়েও মেকানিক আনতে পারছি না। সামনের মৌসুমের আগে ঠিক করতে না পারলে এটা দিয়ে কী করব। আমাকে কোম্পানি একটা নিম্নমানের পুরোনো গাড়ি দিয়েছে, লাখ লাখ টাকা খরচ করেও আমাকে ভুগতে হচ্ছে।’ এসব অনিয়ম তদন্তে এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) এ টি এম সাইফুল ইসলাম ও উপসচিব সুজয় চৌধুরী। তবে সাত মাস পরও তদন্ত শেষ করতে পারেনি এ কমিটি। জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা) এ টি এম সাইফুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘এটি অনেক বড় একটি প্রকল্প। আমরা মাঠপর্যায় থেকে সব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি, করছি। এর মধ্যে অনিয়ম বা দুর্নীতি হয়েছে কি না, সেটি এখন বলতে পারব না। তদন্তকাজ শেষ হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রতিবেদন পাঠানো হবে। সেখানে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের সংশ্লিষ্টতা থাকলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শুরুতে এ প্রকল্পটির পরিচালক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন মো. বেনজীর আহমেদ। সে সময় থেকেই এ প্রকল্পে অনিয়ম চলে আসছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক হন তারিক মাহমুদুল ইসলাম। অনিয়মের নানা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বর্তমান প্রকল্প পরিচালক কালবেলাকে বলেন, ‘আগে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, জানা নেই। তবে প্রকল্প ভালোভাবে চলছে। কোনো দুর্নীতি বা তদন্ত কমিটি সম্পর্কে আমার জানা নেই।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব ওয়াহিদা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয় তার সব প্রকল্পের প্রতি খেয়াল রাখছে। কোথাও কোনো সমালোচনা হলে সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প নিয়ে যেসব কথা এসেছে, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। প্রকল্পটিতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেজন্য প্রকল্প তদারকিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।’ এই প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে দুদকের নির্দেশনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে : এলডিপি মহাসচিব

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ডানা, পশ্চিমবঙ্গের ৮ জেলায় স্কুল বন্ধ

‘শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আইজিপির কাছে’

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে খুমেক হাসপাতাল, বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সেবা

জনবল নেবে সেভ দ্য চিলড্রেন, থাকছে না বয়সসীমা

নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড় ‘ডানা’য় পরিণত

প্যারিসে ফিলিস্তিনপন্থিদের ব্যাপক বিক্ষোভ

পটুয়াখালীতে নারীসহ যুবলীগ নেতা আটক

পপুলার ফার্মায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি

পুতিন-মোদি বৈঠক, পারস্পরিক সাহায্যে জোর

১০

বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপ, উত্তাল সাগর

১১

আজ টিভিতে দেখা যাবে যেসব খেলা

১২

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৩

তেলবাহী ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত, খুলনার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ

১৪

২৩ অক্টোবর : নামাজের সময়সূচি 

১৫

বুধবার রাজধানীর যেসব মার্কেট বন্ধ

১৬

‘সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে’

১৭

ইউএনএফপিএ এবং জাপান সরকারের মাঝে ৪০ কোটি টাকার সহায়তা চুক্তি

১৮

‘রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে কোনো চক্রান্ত করার সুযোগ দেওয়া হবে না’

১৯

বুলগেরিয়ায় পড়তে ইচ্ছুক বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

২০
X