টাঙ্গাইল-৩ আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার ন্যাম ভবনের বাসায় এক নারীকে হেনস্তার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনার প্রতিকার ও জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষিকা। সেখানে এমপি রানা নন, অভিযুক্তদের তালিকায় আছেন তার স্ত্রী ও সন্তানরা। ওই নারীর অভিযোগ, গত ৩ মার্চ ঢাকার ন্যাম ভবনের বাসায় তাকে ডেকে নিয়ে যান রানার বড় মেয়ে। সেখানে এমপির স্ত্রী ও তিন সন্তান মিলে তার ওপর নির্যাতন চালান।
এ ঘটনা জানাজানির পর ঘাটাইল উপজেলাসহ টাঙ্গাইলজুড়ে চলছে নানা আলোচনা। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে নানা ডালপালা। এসব কারণে অনেকের প্রশ্ন, ন্যাম ভবনে এমপি রানার বাসায় সেদিন আসলে কী ঘটেছিল? টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী নেতার পরিবারের বিরুদ্ধে অভিযোগকারী কে এই নারী? স্ত্রী-সন্তানদের অভিযুক্ত করলেও এমপি রানার বিরুদ্ধে কেন আঙুল তোলা হলো না? রানা বা তার পরিবারের সঙ্গে কী তার সম্পর্ক? কী নিয়েই বা সৃষ্টি হলো শত্রুতা?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান চালায় কালবেলা। আর তাতেই বেরিয়ে এসেছে নির্যাতনের অভিযোগের নেপথ্যের ঘটনা।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বিতর্কিত নানা কর্মকাণ্ডের কারণে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত আমানুর রহমান খান রানা। জেলা আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার প্রধান আসামি তিনি। বিচারাধীন এ মামলায় ইতোমধ্যে প্রায় দুই বছর কারাভোগ করেছেন রানা। ওই ঘটনায় তিনিসহ তিন ভাইকে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ফলে সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাননি। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জিতে যান রানা। বিভিন্ন সময়ে রিভলবার ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি, রাজনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মানহানি, অভ্যন্তরীণ বিবাদে রাস্তা অবরোধসহ অসংখ্য ঘটনায় বিতর্কিত হয়েছেন এই রানা। এবার সংসদ সদস্য হিসেবে সরকারিভাবে বরাদ্দ পাওয়া বাসায় নারীকে হেনস্তার ঘটনায় ফের আলোচনায় এসেছেন টাঙ্গাইলের এই নেতা।
জানা গেছে, ন্যাম ভবনে এমপি রানার বাসায় গত ৩ মার্চ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন টাঙ্গাইলের এক হাইস্কুলের শিক্ষিকা। ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে তিনি গত ৭ মার্চ রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। এতে বলা হয়েছে, এমপি রানার বড় মেয়ে জান্নাতুল তাসনুভা খান রক্তিম (২৫) গত ৩ মার্চ সকাল ১০টায় ওই নারীর স্বামীর মোবাইল নম্বরে ফোন করে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ন্যাম ভবনের বাসায় যেতে বলেন। ওইদিন রাত ৮টায় তিনি স্বামীসহ ন্যাম ভবনের বাসায় পৌঁছান।
অভিযোগে ওই নারী উল্লেখ করেন, ‘আমাদের বাসার ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর এমপি রানার মেয়ে তাসনুভা, জান্নাতুল মাওয়া খান সুমাইয়া, ছেলে ওমর ফারুক, স্ত্রী ফরিদা রহমান খান আমাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন। আমি তাদের শান্ত করার চেষ্টা করলে তারা আমাকে কিলঘুসি মারেন। তখন আমার মোবাইল ফোন (আইফোন ১৫ প্রো মেক্স) তাদের বাসায় পড়ে যায়। একপর্যায়ে বিবাদীরা আমাকে ও আমার পরিবারের সদ্যদের প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দেন।’
মোবাইল ফোন ফেরত পাওয়া, আসামিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে বলে লিখিত বিবরণে উল্লেখ করা হয়।
এই জিডির বিষয়টি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে এলাকায় চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। থানায় করা জিডির কপি এখন সবার হাতে হাতে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নির্যাতনের অভিযোগ আনা ওই নারী টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের পূর্ব পাকুটিয়া ইউনিয়নের একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। এমপির গ্রামের বাড়ি, চেম্বার থেকে শুরু করে ঢাকার বাসায় অবাধে যাতায়াত করতেন ওই শিক্ষিকা। রানাও সময়-অসময়ে তাকে ঢাকার বাসা কিংবা চেম্বারে ডেকে নিতেন। আবার ওই নারীর বাসায়ও রানার যাতায়াত ছিল বলেও জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাদের মধ্যে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা এই সম্পর্ককে অনেকেই বলছেন পরকীয়া।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষিকার সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠতার বিষয়টি সামনে আসার পর সম্প্রতি এ নিয়ে তৎপর হন এমপি রানার পরিবারের সদস্যরা। এক পর্যায়ে এমপির বড় মেয়ে রক্তিম ওই নারীকে খবর দিয়ে ঢাকার ন্যাম ভবনের বাসায় নিয়ে আসেন। সেখানে বাদানুবাদের সূত্র ধরে হেনস্তার ঘটনা ঘটে। এর চার দিন পর শেরেবাংলা থানায় জিডি করেন ওই নারী। এতে এমপি রানার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেননি তিনি।
শিক্ষিকার দায়ের করা জিডির পরিপ্রেক্ষিতে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব পেয়েছেন শেরেবাংলা নগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সাব্বির আলম। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি এরই মধ্যে মীমাংসা হয়ে গেছে। বাদী নিজেই আমাদের মীমাংসার কথা জানিয়েছেন। সে কারণে আর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
জানা গেছে, ন্যাম ভবনের ওই ঘটনা ঘাটাইলসহ টাঙ্গাইলের বিভিন্ন এলাকায় জানাজানি হয়ে যায়। এর পরই দেশের বাইরে চলে যান ওই নারী। অনেকের মতে, এমপি রানাই কৌশলে তাকে ওই শিক্ষিকাকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার ঘাটাইল উপজেলার বাড়িতে গিয়ে ওই শিক্ষিকাকে পাওয়া যায়নি। তার স্বামী কালবেলাকে জানান, তার স্ত্রী বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন।
এমপি রানার বাসায় নির্যাতন ও থানায় জিডি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এসব বিষয়ে আমি কিছু জানি না। মীমাংসা হয়েছে কি না আমার জানা নেই।’
এলাকাবাসীর দাবি, এমপি রানার সঙ্গে ওই নারীর ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ থাকায় তার সন্তানরা বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। এর জের ধরেই বাসায় ডেকে তাকে মারধর করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানার জন্য টেলিফোন করা হলে সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা কালবেলাকে বলেন, ‘সাধারণ ডায়েরিতে যেসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, আমার ন্যাম ভবনের বাসায় সে রকম কিছু হয়নি।’
অভিযোগকারী নারীকে আপনি চিনতেন কি না বা কেন তাকে বাসায় ডেকে আনা হয়েছিল—এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি ‘ব্যস্ততার মধ্যে আছি, পরে কথা বলো’ বলে ফোন কেটে দেন।
অন্যদিকে এমপি রানার মেয়ে জান্নাতুল তাসনুভা রক্তিমকে টেলিফোন করে সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তিনি লাইন কেটে দেন।
এদিকে ঘাটাইলের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, সংসদ সদস্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে ওই নারী এলাকায় ব্যাপক প্রভাবশালী। তার জীবনযাপনের ধরন শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। কাউকেই তিনি তেমন পরোয়া করতেন না। রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা বিষয়ে তিনি প্রভাব বিস্তার করতেন। অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণও করতেন।
ওই শিক্ষিকার একাধিক স্বজন জানান, ‘এমপির সঙ্গে তার এতই সখ্য ছিল যে, এলাকার সবকিছুতেই এমপির ভয় দেখাতেন। আমাদের তো অনেক কিছুই বলার আছে, কিন্তু ভয়ে বলতে পারি না। মাঝেমধ্যেই দেখা যেত, বিশাল গাড়িবহর বাসার সামনে। তবে কিছুদিন ধরে দেখি না। তাকেও এলাকায় দেখা যাচ্ছে না।’
ঘাটাইলের দেউলাবাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি জোয়াহেরুল ইসলাম খোকন কালবেলাকে বলেন, ‘সাধারণ ডায়েরির কপিটা ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ায় এলাকায় রীতিমতো তোলপাড় চলছে। জেলায় সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা এটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মহিলার সঙ্গে এমপির অনেকদিন ধরেই বেশ সখ্য ছিল। তাই এমপি তাকে মারধর করেননি। করেছেন তার সন্তানরা।’
গত নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানার নির্বাচনী কাজেও ওই শিক্ষিকা বেশ সক্রিয় ছিলেন বলে জানান এ আওয়ামী লীগ নেতা।
ঘাটাইল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুল ইসলাম লেবু কালবেলাকে বলেন, ‘এটি আমাদের এলাকার জন্য নিন্দনীয় ও লজ্জার ব্যাপার। একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের বাড়িতে একজন নারীকে ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা আইনের চোখে অপরাধ। এমপির সঙ্গে তার এমন কী হলো যে, তার স্ত্রী ও সন্তানরা এমন কাণ্ড করলেন? এলাকার মানুষ এই ঘটনা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না।’
থানায় জিডি করাসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলার জন্য ওই শিক্ষিকাকে ফোন করা হলে তার মোবাইল ফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।