জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০২:৫৩ এএম
আপডেট : ০৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:০৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অবসানের পথে ইভিএম যুগ

প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ছে না
অবসানের পথে ইভিএম যুগ

বহুল আলোচিত ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ছে না। চলতি জুনেই এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এমন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। নতুন যন্ত্র ক্রয় কিংবা পুরোনোগুলো সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্য অর্থ বরাদ্দ না দেওয়ার বিষয়ে এরই মধ্যে সরকারের দিক থেকে নির্বাচন কমিশনকে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ কারণে এই ইস্যুতে ইসিও একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছে। নতুন করে অর্থ বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে এখন অকেজো ইভিএম যন্ত্রগুলো ধ্বংস করার প্রক্রিয়া নিয়েই বেশি ভাবছে সাংবিধানিক সংস্থাটি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় আপাতত ইভিএম যুগের অবসান ঘটছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

সরকারের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার অন্তত পৌনে তিনশ প্রকল্পের মেয়াদ শিগগির শেষ হতে যাচ্ছে। তবে নানা কারণে এসব প্রকল্পের মেয়াদ আর বাড়ানোর পক্ষে নয় সরকার। সে তালিকায় ইভিএম প্রকল্পটিও রয়েছে। সেজন্য জুনে

নির্ধারিত মেয়াদের পর এ প্রকল্প আর না থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এরই মধ্যে কমিশনকে সে আভাস দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো বা অর্থ সংস্থানের চেয়ে অকেজো ইভিএম ধ্বংস করার প্রক্রিয়া নিয়েই আগ্রহ বেশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। সে ক্ষেত্রে সরকার প্রকল্পের মেয়াদ না বাড়ালে জুনের পরেই নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকা ইভিএমগুলো পুড়িয়ে ধ্বংস করার উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে।

নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, ‘ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ আগামী জুনে শেষ হচ্ছে। এরপর আর্থিক জোগান না থাকলে ইভিএমগুলো ধ্বংসের ডিসপোজালের ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন আমরা সরকারের কাছে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে চিঠি দেব।’

জানা গেছে, ইভিএম যন্ত্রগুলো মেরামত ও সংরক্ষণ নিয়ে অনেক দিন ধরেই মহাবিপাকে রয়েছে নির্বাচন কমিশন। পাঁচ বছর আগে উচ্চমূল্যে কেনা ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএমের মধ্য বর্তমানে মাত্র ৪০ হাজার মেশিন সচল রয়েছে। ইভিএম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ) ও ইসির পরীক্ষায় দেখা যায়, অনেক ইভিএম ভাঙা ও ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে যন্ত্রের ভেতর পানি ও কাদামাটি জমে আছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘সিকিউরড কানেকটিং কেবল’ নেই। ১০ বছর সচল থাকার কথা থাকলেও মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে অচল হয়ে আছে যন্ত্রগুলো। ইভিএম মেরামত বা সংরক্ষণে কোনো বরাদ্দ না থাকায় এখানে সেখানে অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে। প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা অনেক ইভিএম এখন আবর্জনায় পরিণত হয়েছে। গোডাউন ভাড়া না নিয়ে বিভিন্ন স্থানে রাখা ইভিএমগুলো সরিয়ে নিতে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তাতে সাড়া দিচ্ছে না কমিশন। বিষয়টি নিয়ে মাঠ কর্মকর্তারা চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে মাঝেমধ্যে কোনো কোনো সংস্থার সঙ্গে মনোমালিন্য বিবাদে জড়াতে হচ্ছে কর্মকর্তাদের।

নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইভিএম প্রয়োগের শুরু থেকেই এ যন্ত্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় অনেক রাজনৈতিক দল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইভিএমের চাহিদা এখন তলানিতে নেমেছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শুরুতে দেড়শ আসন এবং পরে ৭০ থেকে ৮০ আসনে সম্পূর্ণ ইভিএমে ভোট গ্রহণ করার ঘোষণা দেওয়া হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা এবং পর্যাপ্ত ইভিএমের অভাবে শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে কমিশন। ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কোনো আসনেই ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়নি। অবশ্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কাগজের ব্যালটে ভোট হলেও গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত ময়মনসিংহ সিটিতে সাধারণ এবং কুমিল্লা সিটির উপনির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। আর আগামী ৮ মে প্রথম দফার ১৫২টি উপজেলা নির্বাচনে মাত্র ২২টিতে ইভিএমে ভোট গ্রহণের কথা জানিয়েছে ইসি। ইভিএম নিয়ে জনগণের অনাগ্রহ এবং সচল ইভিএমের অভাবে এসব যন্ত্রের ব্যবহার যেন দিন দিন কমছে। এ অবস্থায় ইভিএমের ভবিষ্যৎ নিয়ে খোদ কমিশনই সন্দিহান।

একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে কেএম নুরুল হুদা কমিশন দেড় লাখ ইভিএম কিনলেও, সেগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ইভিএম কেনা এবং পুরোনো ইভিএম সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নির্বাচন কমিশনের নেওয়া ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প সরকার স্থগিত করে দেয়। ফলে হাতে থাকা পুরোনো ইভিএমগুলো সচল রাখতে চরম বেগ পেতে হচ্ছে আউয়াল কমিশনকে। সমস্যা সমাধানে মাত্র পাঁচ বছর আগে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার প্রকল্পে ক্রয়কৃত ইভিএমগুলা সচল করতে আরও ১ হাজার ২৫৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র দেয় কমিশন। ইভিএম মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা বরাদ্দ চেয়ে চিঠি চালাচালির পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকও করে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। বৈঠকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে চরম হতাশ সংস্থাটি। ইভিএমের ভবিষ্যত জানতে সম্প্রতি আবারও সরকারকে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত পেতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এ চিঠি দেওয়া হবে।

২০১০ সালে ইভিএম চালুর পর স্থানীয় নির্বাচনেই তা ব্যবহার হচ্ছিল। এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ওই ইভিএম সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল, কিন্তু সংসদ নির্বাচনে নিতে পারেনি। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজো অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল। তখন সিটি নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার হোঁচট খায়। এরপর কে এম নুরুল হুদার কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ২৪ লাখ টাকা ব্যয়ে দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন পায়। আইন সংশোধন করে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনে ইভিএম ব্যবহারও করা হয়। পরে সংসদের উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকারের সাধারণ ও উপনির্বাচন মিলে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি নির্বাচন হয়েছে ইভিএমে।

ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, সংরক্ষণে অব্যবস্থাপনা, বিপুলসংখ্যক যন্ত্রাংশ অকেজো, প্রয়োজনীয় বরাদ্দ না পাওয়া বা বরাদ্দ প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তার কারণে সংকটে পড়েছে নির্বাচন কমিশনের ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) প্রকল্পটি।

ইভিএমের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল সৈয়দ রাকিবুল হাসান বলেছেন, ‘ইভিএম যন্ত্র সংরক্ষণ, অকেজোগুলো মেরামতসহ প্রকল্পের চলমান কার্যক্রমে আর্থিক সংকট রয়েছে। এসব যন্ত্র মেরামতের জন্য কোনো অর্থের জোগান নেই।’

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, ‘চলমান ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সরকার থেকে নতুন বরাদ্দ না দিলে আগামী জুনে এই প্রকল্প বন্ধ করে দিতে হবে। তখন যেসব ইভিএম আছে, সেগুলো সরকারি আইন মেনে স্থায়ীভাবে অকেজো/অপসারণ করা হবে। এ পর্যায়ে আমাদের হাতে থাকা সচল ইভিএম দিয়ে উপজেলা নির্বাচনের ভোট শেষ করা যাবে। আর অর্থ না পেলে উপজেলা নির্বাচনের মাধ্যমেই শেষ হয়ে যাবে আধুনিক প্রযুক্তির এই ভোট ব্যবস্থাপনা।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

রাজশাহীর মেসগুলোতে নির্যাতিত ছাত্রীরা, বিচারহীনতায় বেপরোয়া মালিকরা 

সচিবালয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মতো স্বাস্থ্যসেবা পাবেন সাংবাদিকরা

গভীর রাতে শীতার্ত মানুষের পাশে বিএনপি নেতা আমিনুল হক

পাহাড় কাটা, নিষিদ্ধ পলিথিনের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান জোরদার করা হবে : পরিবেশ উপদেষ্টা

সাবেক এমপি হেনরীসহ তার স্বামীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

ঢাকা রিজেন্সির এমডি কবির রেজার সস্ত্রীক দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

বাংলাদেশি কর্মী নেবে লিবিয়া

দৌড়ে ছিনতাইকারীকে ধরলেন তেজগাঁওয়ের ডিসি

রাজধানীতে একদিনে ৯৩ ছিনতাইকারী গ্রেপ্তার

ফ্রান্সকে চোখ রাঙাচ্ছে আফ্রিকার দুর্বল দেশ

১০

ঢাকা রিজেন্সির পরিচালক আরিফ মোতাহারের সস্ত্রীক দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

১১

টাঙ্গাইলে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩

১২

সাবেক এমপি ছেলুনের ৩৫ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

১৩

জমিসংক্রান্ত বিরোধে আহম্মেদ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা

১৪

চাঁদপুরে ডাকাতের হাতে নিহত ৭

১৫

হত্যা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান কারাগারে

১৬

এবার জার্মানিতে হামলা চালাতে পারেন পুতিন

১৭

অবৈধভাবে বালু উত্তোলন বন্ধে গ্রামবাসীর মানববন্ধন

১৮

বাসচাপায় সিআরপির ছাত্র নিহতের প্রতিবাদে সাভারে সড়ক অবরোধ

১৯

আল্লু অর্জুনের বাড়িতে ভাঙচুর

২০
X