রাজকুমার নন্দী
প্রকাশ : ৩১ মার্চ ২০২৪, ০৩:৩২ এএম
আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৪, ১১:৩৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভবিষ্যতের স্বার্থে বিএনপিতে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের তাগিদ

বিগত আন্দোলন
ভবিষ্যতের স্বার্থে বিএনপিতে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের তাগিদ

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলন নিয়ে বিএনপি একটি তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন করলেও ভবিষ্যতের স্বার্থে পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের তাগিদ অনুভব করছেন দল ও যুগপতের মিত্ররা। তারা মনে করেন, পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারিত না হলে আগামীর আন্দোলনে সফলতা নিয়েও সংশয় থেকে যাবে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা হাইকমান্ডকে এমন পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগে নির্বাচনের পর ১৩ জানুয়ারি বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠকে একই পরামর্শ দেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারাও। বিএনপির কাছে একই চাওয়া যুগপতের অন্য মিত্রদেরও। তাদের প্রত্যাশা, বিএনপি মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা জামিনে কারামুক্ত হওয়ায় তারা এখন বিগত আন্দোলনে সফলতা-ব্যর্থতার একটা পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করবেন।

বিএনপি বছরের অধিক সময় ধরে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন করলেও চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। বিএনপি ও মিত্রদের বর্জন ও আন্দোলনের মুখে গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপির দাবি, তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ওই নির্বাচন বর্জন করেছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক পরাজয় এবং তাদের নৈতিক বিজয় হয়েছে। তবে রাজপথের কর্মসূচিতে সরকারের পতন না হওয়ায় নির্বাচনের পর পরই আন্দোলনের সাফল্য-ব্যর্থতার মূল্যায়ন শুরু করে বিএনপির হাইকমান্ড। সীমিত পরিসরের ওই মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি বলে মনে করে দল। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে অঙ্গসংগঠনের কমিটি ভেঙে দেওয়াসহ বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে দেড় মাসের মতো মেয়াদ থাকা সত্ত্বেও গত ১ মার্চ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন আংশিক কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে গঠন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নতুন আংশিক কমিটিও।

সারা দেশে বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। আন্দোলনে ২০ থেকে ২৫টি জেলার পারফরম্যান্স সন্তোষজনক ছিল না বলে দলের মূল্যায়নে উঠে আসে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, শুধু এসব জেলা ও মহানগরে দল ও অঙ্গসংগঠনের কমিটি ভেঙে আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয়দের দিয়ে কেন্দ্র থেকে নতুন কমিটি গঠন করা হবে। এক্ষেত্রে কোনো কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও ওই কমিটির নেতারা আন্দোলনে সক্রিয় থাকলে তা বিলুপ্ত করা হবে না। ঈদের পর তৃণমূলে এই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে।

এদিকে মূল্যায়নে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গসহ নানা কারণে বিভিন্ন সময় বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া নেতাদেরও দলে ফেরানোর সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে ২৮ অক্টোবরের পর থেকে আন্দোলনে যেসব নেতা নিজেরা সরাসরি মাঠে সক্রিয় ছিলেন কিংবা তাদের তত্ত্বাবধানে বা তাদের বলয়ের নেতাকর্মীরা রাজপথে ছিলেন এবং কেন্দ্রের সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় রক্ষা করেছেন, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এমন প্রায় ২৫ নেতার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে। তাদের পদোন্নতি দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি।

নির্বাচনের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ কারাবন্দি অধিকাংশ নেতা এরই মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। দলটি এখন দেশব্যাপী কারামুক্ত নেতাদের নিয়ে ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে তৃণমূলে সংগঠন ও নেতাকর্মীদের হতাশা কাটিয়ে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ২৫ মার্চ স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠক হয়। জানা যায়, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ রাজপথে যুগপতের শরিক কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বিষয়ে দলের অবস্থান কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে ভার্চুয়াল মাধ্যমে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে আলোচনা হয়। ভারত পার্শ্ববর্তী ও প্রভাবশালী রাষ্ট্র হওয়ায় সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে কৌশলী অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হলেও সেই কৌশল কী হবে, তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

বৈঠক সূত্র জানায়, ওই আলোচনার একপর্যায়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘ আন্দোলন করেছি। সবসময় বড় আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয়। পূর্ণাঙ্গ সেই মূল্যায়ন আমরা করিনি। আমাদের উচিত আগে সে মূল্যায়ন করা, তারপর তার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণ করা, অর্থাৎ আমরা কোন পথে যাব। আমরা যদি ভারত বিরোধিতা করি, তাহলে তার কৌশল কী হবে সেটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। এটা নিয়ে আগামীতে পরিপূর্ণ আলোচনা হওয়া উচিত। তারপর কৌশল ঠিক করতে হবে।

এর আগে স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকের দিন দুপুরে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন বিএনপি মহাসচিব। সেখানে তিনি বলেন, ‘পুলিশের হুইসেল, গুলি-গ্রেনেডের শব্দে ভয়ে যারা পালাবে না, যারা রাস্তায় অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, প্রাণ দেবে—এমন তরুণ যুবক, সাহসী নেতৃত্ব তৈরি করতে হবে।’

জানা গেছে, মির্জা ফখরুলের ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে হামলা, মামলা, গ্রেপ্তার, গুলি উপেক্ষা করে সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে ছিলেন, তারা আশান্বিত হয়ে উঠেছেন। কারণ, নেতাকর্মীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ, আন্দোলনে রাজপথে থাকলেও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের লোক দিয়ে গঠন করা হয় পকেট কমিটি। এই কারণে সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনও সফলতা পায়নি বলে মনে করেন অনেকে। তবে তাদের প্রত্যাশা, এবার এর ব্যতিক্রম ঘটবে, ত্যাগীরা সর্বক্ষেত্রে মূল্যায়িত হবে। অন্যথায় আগামীর আন্দোলনেও তেমন সুফল পাওয়া যাবে না।

সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনের একটা পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হওয়া উচিত বলে মনে করেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও যুগপতের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল। তিনি কালবেলাকে বলেন, প্রতিটি কর্মকাণ্ডের সফলতা-ব্যর্থতা-সার্থকতা সবকিছুরই একটা মূল্যায়ন হওয়া উচিত। মূল্যায়ন ছাড়া মানুষের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনও তো আবর্তিত হয় না। সুতরাং বিগত আন্দোলনের একটা পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন হওয়া দরকার। না হলে ভবিষ্যতে চলার পথে যদি আবারও একই ধরনের পুনরাবৃত্তি ঘটে, তখন কী করতে হবে, সেটি এই মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসবে।

যুগপতের মিত্ররাও ভবিষ্যৎ আন্দোলনের স্বার্থে বিগত আন্দোলনের একটা পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন চান। এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, সরকারবিরোধী দীর্ঘ একটা আন্দোলন গেল। এতবড় সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলার পরেও আন্দোলনটা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারল না, এর একটা সামগ্রিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা হওয়া দরকার। অন্যথায় পরবর্তী আন্দোলন গঠন করার ক্ষেত্রে সমস্যা হবে। গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের পর ১৩ জানুয়ারি বিএনপির সঙ্গে মিটিংয়ে আমরা আমাদের পর্যালোচনাগুলো বলেছি। আমরা বিএনপিকে বলেছি, কেন আওয়ামী লীগ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা যায়নি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করা যায়নি—খোলা মনে আপনারা এগুলো নিয়ে আলোচনা, রিভিউ করেন। তারপর আপনাদের সঙ্গে আমরা আবার বসব। কিন্তু সেই মুলতবি সভা পরবর্তী সময়ে আর হয়নি।

সাইফুল হক আরও বলেন, বিএনপি মহাসচিবসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা এরই মধ্যে জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন। এখন তারা হয়তো একটা পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করতে পারবেন। আমরা চাই, আন্দোলনের প্রধান শরিক হিসেবে বিএনপির সফলতা কোথায়, ব্যর্থতা কোথায়, ব্যর্থতা কী নেতৃত্বের নাকি সাংগঠনিক কৌশলের—সেটা তারা খুঁজে বের করুক। সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতে ঈদের পর গণতন্ত্র মঞ্চসহ যুগপতের বাকি শরিকদের সঙ্গেও বিএনপির বৈঠক হবে বলে প্রত্যাশা তার।

১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার কালবেলাকে বলেন, ভবিষ্যতের স্বার্থে বিগত আন্দোলনের সফলতা-ব্যর্থতার একটি সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন আমরা চাই। তবে তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো, আগামীর আন্দোলন সফলে শরিক দল কিংবা জোটের সবাইকে নিয়ে একটা ‘অলআউট ইউনিটি’ করা যায় কি না? তাই বিএনপির কাছে শরিক দল ও জোটগুলোর দাবি ও প্রত্যাশা, আমাদের ঐক্যটাকে আরও সুসংহত ও সম্প্রসারিত করা হোক। এক প্ল্যাটফর্মে যদি একান্ত সম্ভব নাও হয়, সবাইকে একই দিনে, একই সঙ্গে একই কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে হবে। সেটাই হবে সত্যিকার অর্থে যুগপৎ আন্দোলন।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কনসার্ট শেষে মাঠ পরিষ্কার করল ঢাকা কলেজ ছাত্রদল

পটুয়াখালীতে শ্রমিকদল নেতা বহিষ্কার

ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পেছনে কলকাঠি নেড়েছে সৌদি, বুশরা বিবির দাবি

১৫ বছর পর আগুন…

সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান

ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা হবে : বাকৃবি উপাচার্য

চাকরি দিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স 

ফ্যাসিবাদ নির্মূলে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান : আদিলুর

সেতু সংস্কারে ধীরগতি, দুর্ভোগে লক্ষাধিক মানুষ

লেবানন থেকে আরও ৮২ বাংলাদেশি দেশে ফিরেছেন

১০

জবি শিক্ষককে হত্যার হুমকির অভিযোগ, থানায় জিডি

১১

আইপিএল নিলামের তালিকায় ফিরলেন আর্চার

১২

সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে বৃদ্ধ নিহত

১৩

আখাউড়া সীমান্ত থেকে দুই নারী আটক

১৪

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত আইনজীবীদের জয়

১৫

টানা ৩ দিন ধরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা তেঁতুলিয়ায়

১৬

নতুন সিইসি ও কমিশনারদের শপথ রোববার

১৭

সবচেয়ে ভয়ংকর ৪ কবিরা গুনাহ 

১৮

জুমার দিন মসজিদে হেঁটে যাওয়ার পুরস্কার

১৯

কোনো রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ চায় না জাতীয় পার্টি

২০
X