বাংলাদেশ নিয়ে ফের অসন্তুষ্টির কথা উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পর্যবেক্ষণে। এ বিষয়ে দেশটির বাণিজ্য দপ্তরের (ইউএসটিআর) এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে—সরকারি কেনাকাটা, মেধা-সম্পদ সংরক্ষণ, ডিজিটাল বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শ্রমিক অধিকারের মতো বিষয়গুলোয় বাংলাদেশে বড় অস্বচ্ছতা রয়েছে। এখানে ঘুষ, দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে। এসব ঘাটতি নিয়ে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য এগিয়ে নেওয়া কঠিন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে গত শুক্রবার ইউএসটিআর ২০২৪ সালের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যে বাধাবিষয়ক এই মূল্যায়ন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে। মার্কিন বাণিজ্যমন্ত্রী ক্যাথরিন টাই ৩৯৪-পৃষ্ঠার বার্ষিক ওই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পরে প্রতিবেদনটি ইউএসটিআরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। এতে বিশ্বের ৬০টি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে অশুল্ক বাধার বিষয়টি জোরালোভাবে উঠে এসেছে। বিশেষ করে ঘুষ-দুর্নীতিকে বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে ঘুষ ও চাঁদা দেওয়ার ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও দুর্নীতিবিরোধী আইনের প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। লেনদেন ও উপহার অবৈধ হওয়া সত্ত্বেও বাণিজ্যিক লেনদেনে ঘুষ ও চাঁদাবাজি বাংলাদেশে সাধারণ বিষয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ এখনো ‘কাস্টমস ভ্যালুয়েশন লেজিসলেশন’ সম্পর্কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে (ডব্লিউটিও) অবহিত করেনি।
প্রতিবেদনে ওঠে আসা মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও অভিযোগ হচ্ছে, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ চাওয়ার কারণে লাইসেন্স ও দরপত্রের অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। কিন্তু সেখানে দুর্নীতিবিরোধী প্রধান সংস্থা দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা খর্ব করতে উল্টো ক্রমাগত প্রস্তাব আসছে।
দরপত্রবিষয়ক ইস্যুতে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ও বাছাই প্রক্রিয়ার কথা বলে থাকে। কিন্তু বেশকিছু মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইউএসটিআরে অভিযোগ দিয়েছে—বিদেশি প্রতিযোগীরা প্রায়ই তাদের স্থানীয় অংশীদারদের ব্যবহার করে ক্রয়প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাকে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে দরপত্রে বিজয়ী হতে না পারে। মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে কারচুপির বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে অভিযোগ করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো অভিযোগ করে বলেছে, ঘুষ, প্রতিযোগিতাবিরোধী চর্চা, দরপত্রের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাব—এসব বিষয় সরকারি দরপত্রে মার্কিন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের পথে বাধা। সরকারি কেনাকাটা সাধারণত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৬-এর আওতায় দরপত্রের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশ প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের নীতি অনুসরণ করলেও দুর্নীতির অভিযোগ সাধারণভাবেই রয়ে গেছে। বাংলাদেশ জাতীয়ভাবে ইলেকট্রনিক সরকারি ক্রয় পোর্টাল চালু করেছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীজন পুরোনো প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি পছন্দের দরদাতার স্বার্থে পক্ষপাতমূলক শর্তজুড়ে দেওয়া ও দরপত্রের সামগ্রিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রতিবেদনে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণে ঘাটতির বিষয়ও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আইন সংস্কারের মাধ্যমে মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ, বাংলাদেশে নকল ও চোরাচালানের পণ্য সহজেই পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের বিকাশে, বিশেষ করে ডিজিটাল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক বিভিন্ন আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে উপাত্ত সুরক্ষা আইন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আইন নিয়ে মার্কিন সরকার এখনো সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তদুপরি বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ থেকে অর্জিত লভ্যাংশ বিদেশে নেওয়ার প্রক্রিয়ায়ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে ইউএসটিআরের প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে রয়েছে আইনি জটিলতা, যা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণের একটা প্রতিবন্ধকতা।
শ্রমিক অধিকারের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিক অধিকার, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মীদের অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য-সুবিধা জিএসপি স্থগিত করেছিল। এটি এখনো বহাল আছে।