দুই যুগের বেশি সময়ের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি। তবে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগ থেকে দুই দলের সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকলেও দুই দল নিজস্ব আঙ্গিকেই কর্মসূচি পালন করেছে। দুই দলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে সম্পর্কোন্নয়নের ইঙ্গিত মিলছে। বিশেষ করে পাঁচ বছর পর বৃহস্পতিবার বিএনপির উদ্যোগে রাজনীতিকদের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে জামায়াতের আমিরসহ চারজন কেন্দ্রীয় নেতার অংশগ্রহণ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে দিয়েছে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও একমঞ্চে পাশাপাশি বসা রাজনীতিতে নতুন বার্তা বা ইঙ্গিত বলে মনে করছেন অনেকে। এদিকে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনের সম্মানে আজ শনিবার ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে জামায়াতে ইসলামী। এতে বিএনপির শীর্ষ নেতারা অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কোন্নয়ন হয়েছে, যা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিজেই দেখাশোনা করছেন। তবে এ নিয়ে দল দুটির কেউ কিছু বলতে চাননি। দলটির নীতিনির্ধারকদের মতে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য যারাই ৭ জানুয়ারির একদলীয় নির্বাচন বর্জন করেছে, তাদের সবাইকে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে জনগণের দাবি আদায়ে একটি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা যায়। বিএনপির এই জাতীয় ঐক্যের ভাবনার বিষয়ে জামায়াতের সঙ্গে কোনো আলোচনা হচ্ছে কি না—এমন প্রশ্নে তারা মুখ খুলছেন না। জামায়াতের এক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কালবেলাকে বলেন, বিএনপির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বেড়েছে। আশা করা হচ্ছে, এটি আরও ভালোভাবে এগোবে।
বিএনপি সূত্রের দাবি, রাজনৈতিক কৌশলের কারণেই তারা জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছেন। দলের হাইকমান্ডের পর্যবেক্ষণ, বিগত দুটি (দশম ও একাদশ) জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বিএনপি ও জামায়াতের জোটবদ্ধ আন্দোলনে কাঙ্ক্ষিত সফলতা আসেনি। বরং ক্ষমতাসীন দলের নেতিবাচক প্রচারণায় ‘বিএনপি-জামায়াত’ সম্পর্ক নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। যে কারণে জামায়াতকে দূরে রেখে সমমনাদের নিয়ে আন্দোলন করেছে বিএনপি। ভোটের হিসাব-নিকাশে জামায়াত ইস্যুতে কৌশলী ও সতর্ক দলটি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’ দলের মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কের স্পষ্ট দূরত্ব তৈরি হয় ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত জামায়াতের একাধিক শীর্ষ নেতার ফাঁসি এবং কারাবন্দি অবস্থায় মৃত্যু হলেও তখন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিএনপি। মূলত ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দল দুটির মধ্যে সম্পর্ক ফিকে হতে শুরু করে। এক পর্যায়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট থেকেই সরে আসে জামায়াত। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট’ নামে নতুন জোট গঠন হলে, সেখানে ছিল না জামায়াত। এমনকি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে সমমনা মিত্র দলগুলো নিয়ে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলন ও এর কর্মসূচি নিয়েও জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা বিএনপি না করায় ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত। তবু যুগপৎ আন্দোলনের শুরুর দিকের দুটি কর্মসূচিতে জামায়াতের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। এরপর আর কোনো কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিজস্বভাবে কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। আন্দোলন চলাকালেই জামায়াতের আমিরকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিএনপি বিবৃতি না দেওয়ায় জামায়াত আন্দোলন থেকে সরে যায়। সেই থেকে দল দুটি একই অবস্থানে রয়েছে। যদিও ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের নায়েবে আমির ও সাবেক সংসদ সদস্য মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে বিএনপি দলীয়ভাবে শোক জানায়। কিন্তু সেই শোকবার্তায় সাঈদীর রাজনৈতিক পরিচয় উল্লেখ করেনি দলটি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়তে গিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠিত হয়, যা পরে ২০ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। জামায়াত নেতারা জানান, ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে। জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া কখনো সংবাদ সম্মেলন করলে জামায়াতের আমির বা শীর্ষ কোনো নেতা পাশে বসতেন। এমনকি তিনি জামায়াতের সঙ্গে যোগাযোগও রক্ষা করতেন। তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিলে, সে বিষয়ে অটল থাকতেন।
একদফা দাবিতে সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলন সামনে রেখে ২০২২ সালের ৯ ডিসেম্বর ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া হয়। অবশ্য ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর বিলুপ্ত জোটের ১২টি দলের সমন্বয়ে ‘১২ দলীয় জোট’ এবং ২৮ ডিসেম্বর আরও ১১টি দল মিলে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠিত হয়। তাতেও জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি। বরং গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতও পৃথক কর্মসূচি পালন করেছে।
জামায়াতের কয়েকজন নেতা কালবেলাকে জানান, বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি ‘ক্ষোভ’ এবং ‘অভিমান’ থেকেই তাদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। কেননা সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিএনপি অন্য সব দলের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করলেও জামায়াতের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি। এর পরও অনেকটা আগ বাড়িয়ে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি পালন করেছে। ২০২২ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর যুগপতের গণমিছিল করতে গিয়ে মালিবাগে জামায়াতের শতাধিক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার ও আহত হন। এ নিয়ে বিএনপির কোনো নেতা বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি। এসব বিষয়ে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ে ব্যাপক সমালোচনা ও ক্ষোভের জন্ম দেয়। কার্যত এর পরই জামায়াত সিদ্ধান্ত নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছে। তবে নিজস্ব আঙ্গিকে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বিএনপির আগে-পরে মাঠে তৎপর ছিল জামায়াত।
আজ ঢাকায় জামায়াতের ইফতার মাহফিল: আজ রাজধানীর হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনকে নিয়ে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছে জামায়াতে ইসলামী। এরই মধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকসহ বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে দলটি। পাশাপাশি ঢাকার বিভিন্ন কূটনীতিকসহ পেশাজীবী ও বিশিষ্টজন এতে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। জামায়াতের ইফতারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ কয়েকজন নেতা অংশগ্রহণ করবেন বলেও জানা গেছে।