উপজেলা নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হলেও দলের তৃণমূলকে এখনো অন্ধকারে রেখেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপি। প্রথম ধাপের নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়ার মাত্র ১৯ দিন বাকি থাকলেও নির্বাচন নিয়ে এখনো দলীয় অবস্থান স্পষ্ট করেনি দলটি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে। অতীতে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচনে যাওয়ায় অনেকের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে দল। এবার এখনো সুনির্দিষ্ট বার্তা না পাওয়ায় দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এ অবস্থায় উপজেলা নির্বাচন নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দলের অবস্থান স্পষ্ট করা উচিত বলে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মনে করেন।
গত ২১ মার্চ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তপশিল অনুযায়ী, এবারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন হবে চারটি ধাপে। প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলায় ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। প্রথম ধাপের নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম জমা দেওয়া যাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২৩ মে, তৃতীয় ধাপের ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৫ জুন।
গত সোমবার বিএনপির স্থায়ী কমিটির নিয়মিত ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উপজেলা নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বৈঠকের আলোচনায় নির্বাচন প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। সেখানে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। তবে দীর্ঘ আন্দোলনের পর সংগঠনের স্বার্থে ‘কৌশলে’ নির্বাচনে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দিলেও সেই কৌশল কী হবে, তা বৈঠকে চূড়ান্ত হয়নি।
সূত্র মতে, বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন বর্জনের চার মাসের মধ্যে সেই সরকারের অধীনে দলীয়ভাবে উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপি যেসব কারণে ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে। সর্বশেষ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন তার প্রমাণ। তাই সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এখন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ‘নৈতিক অবস্থান’ দুর্বল হয়ে যাবে। যারা বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি, তারা বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা ভালোভাবে নেবেন না। তা ছাড়া জাতীয় নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি ঘোষণা দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারের ‘বৈধতা’ পাওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসবে। তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় সরকারবিরোধী আন্দোলনের পর সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সংগঠন ও নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করতে নির্বাচনে কৌশলে অংশগ্রহণের পক্ষে মত দেন তারা। এ আলোচনায় যোগ দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে দলের কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে বহিষ্কারের মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিপক্ষে মত দেন স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য।
দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, এখনো সময় রয়েছে। আমরা এখনই যদি আমাদের কৌশল নিয়ে নিই, তাহলে সরকারও সতর্ক হয়ে যাবে, তাদের কৌশলও পরিবর্তন করে ফেলবে। তাই নির্বাচন নিয়ে আমরা কোন কৌশল অবলম্বন করব, মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ মুহূর্তে তা নির্ধারণ করা হবে।
উপজেলা নির্বাচন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনের ব্যাপারে এখনো আমাদের দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হলে তা জানানো হবে।’
বিএনপি ২০২১ সাল থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করে আসছে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পরও স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে প্রথম দিকে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরকারের ‘নগ্ন হস্তক্ষেপের’ অভিযোগে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি। এর ধারাবাহিকতায় সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনও বর্জন করে। আর দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যারা সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সর্বশেষ গত ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনেও বিএনপি দলীয়ভাবে অংশ নেয়নি। তবে সেখানে দলের সাবেক দুই নেতা মনিরুল হক (সাক্কু) ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন (কায়সার) প্রার্থী হন। এই দুজন ২০২২ সালে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তাদের বহিষ্কারাদেশ এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ আন্দোলনের পর বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় সংগঠন ও তৃণমূলকে আরও চাঙ্গা করতে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে ‘কৌশলী’ ভূমিকা নিতে যাচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে নির্বাচনে দলের কেউ ব্যক্তিগতভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে নমনীয়তা দেখানো হতে পারে। তবে কতটুকু নমনীয়তা দেখানো হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে কৌশলের অংশ হিসেবে বিএনপি পুরো বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারে, অর্থাৎ, ‘বেখেয়াল’ থাকতে পারে। কারণ, দলের অনেকে মনে করছেন, বিএনপি সংসদ নির্বাচনের মতো আসন্ন উপজেলা নির্বাচনও বর্জনের ঘোষণা দিলে অধিকাংশ নেতাই তা মেনে নেবেন। তবে নির্বাচন করতে আগ্রহী অনেকে তা নাও মানতে পারে। স্থানীয় নানাবিধ কারণে তাদের স্থানীয় সরকারের নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট হতে হয়। সরকারবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকারি মামলা-হামলায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এমনিতেই বিপর্যস্ত। এমন পরিস্থিতির মধ্যে কারও বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিলে সংগঠন আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই সংগঠনের স্বার্থে এ ক্ষেত্রে এবার নমনীয়তা দেখাতে পারে দল।
আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় আন্দোলন ইস্যুতে নতুন মূল্যায়নের আলোকে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হাইকমান্ড নতুন করে ভাবতে পারেন বলে অভিমত বিএনপির তৃণমূলের অনেক নেতার।
এ বিষয়ে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারবিরোধী একটি দীর্ঘ আন্দোলন হলেও আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আগে এটার একটা সঠিক মূল্যায়ন হওয়া দরকার। তারপর আমরা কোন পথে যাব— সেটা নতুন করে ঠিক করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় আন্দোলন ও নির্বাচন (স্থানীয় সরকার) একসঙ্গে চলতে পারে কি না—দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও স্থায়ী কমিটি এ ব্যাপারে নতুন করে ভেবে দেখতে পারেন। তবে সবার ঊর্ধ্বে দলের সিদ্ধান্ত এবং সেটাই চূড়ান্ত।’