উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে চায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন মহলের আগ্রহের কারণেই দলটির এমন অবস্থান। সেইসঙ্গে জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় তৈরি হওয়া দলীয় কোন্দল আরও ঘনীভূত হতে পারে—এমন শঙ্কায় দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরও উপজেলা নির্বাচন ঘিরে কোনো পক্ষ যেন দলের নাম ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পারে, সেজন্য কঠোর নজরদারি করবে ক্ষমতাসীনরা। পুরোনো দ্বন্দ্ব ঘিরে কেউ নতুন করে সংঘাতে জড়ালে শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, উপজেলায় দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীক দেওয়ার সুযোগ বহাল থাকলেও এবারের নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক করতে ‘নৌকা’ দিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। ফলে গত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো প্রায় প্রতিটি উপজেলায় দলের একাধিক নেতা প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী দলীয় কিংবা স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রীরা নিজ নিজ সংসদীয় আসনে প্রভাব বজায় রাখতে অনুগতদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছেন। এমনকি গত জাতীয় নির্বাচনে পরাজিত দলীয় প্রার্থী, সাবেক এমপি ও প্রভাবশালী নেতারা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নানা কৌশল অবলম্বন করছেন। এসব কারণে দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিতর্কিত ও সমালোচিত হতে পারে। এ বিষয়ে নজরদারির জন্য আওয়ামী লীগের বিভাগীয় টিম সক্রিয় হচ্ছে।
এবারের উপজেলা নির্বাচন মোট চারটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপে আগামী ৮ মে ১৫২টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উপজেলাগুলোতে ভোট গ্রহণ হবে ইভিএম ও ব্যালট পেপারের মিশেলে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২৩ মে, তৃতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ২৯ মে এবং চতুর্থ ধাপের ভোট হবে ৫ জুন।
স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও দুটি ভাইস চেয়ারম্যান (সাধারণ ও সংরক্ষিত) পদের নির্বাচনের জন্য প্রার্থীকে রাজনৈতিক দল কর্তৃক মনোনীত অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে হবে। আইনটি পাস হওয়ার পর ২০১৭ সালের মার্চে প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে ভোট হয় উপজেলায়। এরপর থেকে সব স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয়। তবে, ২০১৯ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২০১৯ সালের নির্বাচনে সারা দেশে প্রার্থী দিলেও কিছু জেলায় দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় প্রার্থী দেয়নি দলটি।
গত জানুয়ারি মাসে গণভবনে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের এক জরুরি সভায় উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে প্রার্থী না দেওয়ার এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এমনকি দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থীকে সমর্থন না দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। উপজেলা নির্বাচনে দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের বাইরে রাখতে এবং অংশগ্রহণমূলক করতে, বিএনপিসহ অন্যদলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতেও এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বলে নেতারা জানিয়েছিলেন।
নির্বাচন কেন্দ্র করে প্রতিটি উপজেলাতেই সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে প্রচারে নেমেছেন। রোজার সময়কে কেন্দ্র করে এ প্রচার এখন তুঙ্গে। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রার্থীদের একে-অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও কাদা ছোড়াছুড়িও চলছে সমান তালে। একই সঙ্গে অনেক আসনে বর্তমান এমপি ও সাবেক সংসদ সদস্যদের পরিবারের সদস্যরাও নেমেছেন উপজেলায় প্রার্থী হওয়ার আশায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য হয়েও অনেকে নিজের স্ত্রী-সন্তান, ভাই, ভাতিজা, শ্যালক ও অনুগতদের উপজেলাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বানিয়ে এলাকায় কর্তৃত্ব পাকাপোক্ত করতে মাঠে নেমেছেন। আওয়ামী লীগের দপ্তরে এমন অভিযোগ প্রতিদিনই আসছে। অনেকে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেও নানান অভিযোগ দিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি ময়মনসিংহের ত্রিশাল পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে পরাজিত হয়েছেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এ বি এম আনিসুজ্জামানের স্ত্রী শামীমা বেগম। আনিসুজ্জামান আগে পৌরসভার মেয়র ছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে তিনি পদত্যাগ করলেও এমপি হওয়ার পর নিজের স্ত্রীকে পৌর মেয়র বানাতে মাঠে নামেন। এমনকি আচরণবিধি ভঙ্গ করে ভোটও চান। এ নিয়ে প্রতিপক্ষ নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দেয়।
অন্যদিকে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে মেয়র পদে বিজয়ী হয়েছেন সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের মেয়ে তাহসীন বাহার সূচনা। তার জন্য নানাভাবে সক্রিয় ছিলেন এমপি বাহার।
একইভাবে উপজেলার সম্ভাব্য প্রার্থীরা নানাভাবে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীর সমর্থনের আশায় ধরনা দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে আওয়ামী লীগ অংশ নিলে দলের সিদ্ধান্ত অমান্যকারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ হতো। কিন্তু তা না হওয়ায় তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা পড়ছেন বিপাকে। অনেক জায়গায় স্থানীয় শীর্ষ নেতারাই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। এখন কে, কাকে নিয়ন্ত্রণ করবে তা নিয়ে দোটানায় রয়েছে দল ও তৃণমূল।
তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে বলছেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এজন্য যেসব আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, তার পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারলে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হলে দলীয় ও স্বতন্ত্র এমপিরা তাদের পছন্দের লোকের পক্ষে অবস্থান নিলেও ভোটে তার প্রভাব পড়বে না। বাকিটুকু আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে। এরই মধ্য বিভাগীয় টিম তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ঢাকায় ডেকে ধারাবাহিকভাবে বৈঠক করছে। এসব বৈঠকে দলীয় কর্মকাণ্ড সক্রিয় করার পাশাপাশি স্থানীয় দ্বন্দ্ব ও কোন্দল নিরসনে কার্যকর পরামর্শ দিচ্ছেন দলীয় নেতারা।
আওয়ামী লীগ কঠোর মনোভাব জানান দিতে দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কাজের জন্য এমপির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে দেখা যাচ্ছে। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং রাজশাহী-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গত ৯ মার্চ এক অনুষ্ঠানে নিজ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অনিল কুমার সরকারকে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় ভর্ৎসনা করেন। অনিল কুমার সরকার আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করার জন্য এমপির প্রার্থী রয়েছে বলেও জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক কালবেলাকে বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্তেই এবারের নির্বাচনে কোনো প্রার্থী দেওয়া হচ্ছে না। তাই বলে নির্বাচনে অংশগ্রহণের নামে ক্ষমতার অপব্যবহার করে কেউ দলের সুনাম ক্ষুণ্ণ করবে, তা হতে দেওয়া হবে না। নির্বাচনে কঠোর নজরদারি করা হবে। এজন্য দলের প্রতিটি বিভাগে যে সাংগঠনিক টিম আছে তারা কাজ শুরু করেছে। তারা প্রয়োজনে সাংগঠনিক শাস্তি প্রদান করবে।’