চুক্তির দুই মাসের মধ্যে সব পণ্য সরবরাহ করার কথা ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তবে পেরিয়ে গেছে প্রায় এক বছর। এখনো সেই পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। তালিকায় থাকা ১৯ ধরনের পণ্যের মধ্যে তিনটি সরবরাহ করা হলেও দাম ধরা হয়েছে বেশুমার। এর মধ্যে একটি পণ্যের প্রকৃত দাম এক কোটি টাকা হলেও এটি কিনতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সেই পণ্য সরবরাহের সময় প্রত্যাখ্যানও করেছিল। দীর্ঘসময়ে পণ্য সরবরাহ ব্যর্থতা এবং কম দামি পণ্য বেশি দামে সরবরাহের অপরাধে শাস্তি হওয়ার কথা থাকলেও উল্টো পুরস্কৃত হতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এতদিন পর সেই পণ্য নতুন করে বুঝে নিয়ে পরিশোধ করা হবে বিল। কেনাকাটায় লুটপাটের এমন আয়োজন করা হয়েছে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন কর্মকর্তা এবং
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এসপি ট্রেডিং হাউসের যোগসাজশে এমন আয়োজন চূড়ান্ত করা হয়েছে
বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের যন্ত্রাংশ কেনাকাটার ১৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার ঠিকাদারি কাজ পায় এসপি ট্রেডিং হাউস নামের একটি প্রতিষ্ঠান। গত বছরের ৪ জুন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক চৌধুরী সারওয়ার জাহান এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক হাফিজুর রহমান পুলকের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে এক মাসের মধ্যে এই পণ্য সরবরাহের কথা ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তবে এরপর প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এখনো পণ্য বুঝিয়ে দেয়নি।
নথি থেকে জানা যায়, নিউরো সার্জারি বিভাগের নানা ধরনের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করার কথা ছিল ঠিকাদারের। এর মধ্যে কেবল তিনটি পণ্য সরবরাহ করা হয়। সেগুলো হলো ইমেজ গাইডেড নিউরো নেভিগেশন সিস্টেম ফর ক্রানিয়াল অ্যান্ড স্পাইনাল সার্জারি, ইনট্রা অপারেটিভ নার্ভ মনিটর ফর ক্রানিয়াল অ্যান্ড স্পাইনাল সার্জারি সেট এবং থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন মাইক্রোসকোপ সিস্টেম ফর মাইক্রো নিউরো সার্জারি সেট। এর মধ্যে থ্রিডি ভিজ্যুয়ালাইজেশন মাইক্রোসকোপ সিস্টেম ফর মাইক্রো নিউরো সার্জারি সেটের দাম এক কোটি টাকা। তবে এই পণ্যের যে বিল জমা দেওয়া হয়েছে, সেখানে লেখা রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।
সূত্র জানায়, এসব পণ্য সরবরাহ করা হলেও তা গ্রহণ করেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তারা বিলও দেয়নি। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এমন অস্বাভাবিক বিল জমা দেওয়ার বিষয়টি তদন্তও করেনি। সূত্র বলছে, বিষয়টি দফারফার জন্যে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরই ধারাবাহিকতায় আজ রোববার চূড়ান্ত বৈঠক হওয়ার কথা।
সূত্র বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরো কাজের বিল পাওয়ার জন্যে দেন-দরবার করছে। সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে ব্যর্থ হওয়া, অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণসহ নানা দুর্বলতা ধামাচাপা দিতে দৌড়ঝাঁপ করছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে।
জানা যায়, সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ করতে না পারার বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান একটি চিঠি দেয় সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। এতে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে ডলার সংকট হওয়ায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঠিকাদার সময়মতো যন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে পারেননি। ওই চিঠিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তর কর্তৃক মঞ্জুরও হয়। তবে তথ্য বলছে, এর পরও বেশ কয়েকমাস পেরিয়ে গেছে। কিন্তু যন্ত্রপাতিগুলো সরবরাহ করা হয়নি।
এসপি ট্রেডিং হাউসের প্রোপাইটার হাফিজুর রহমান পুলক কালবেলার কাছে দাবি করেছেন, তিনি সব পণ্যই সরবরাহ করেছেন। তার ভাষ্য, ‘কোনো আর্থিক অনিয়ম হয়নি। চুক্তি অনুসারে ১৯ ধরনের পণ্যই তাদের দিয়েছি।’
তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেননি কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের পরিচালক চৌধুরী সারওয়ার জাহান। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা তাদের কাছ থেকে মাত্র ৬টি পণ্য পেয়েছি। রোববার (আজ) সেগুলো সম্পর্কে যাচাই বাছাই করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোনো বিলই এখনো পরিশোধ করা হয়নি। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। সব পণ্য এখনো তারা দেয়নি। কেন তারা সব পণ্য দেয়নি, তার কারণ জানতে চাওয়া হবে। এরপর তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসব পণ্য যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইক্যুইপমেন্ট মেইনটেইনেন্স ওয়ার্কশপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের টেকিনিক্যাল ম্যানেজার এম এন নাশিদ রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘কুষ্টিয়া মেডিকেলের কেনাকাটার বিষয়ে কিছু জানি না। সংশ্লিষ্টরাই ভালো বলতে পারবেন।’