হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তানভীর মাহমুদ ও তার স্ত্রী জেসমিন ইসলামসহ ৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তবে আদালত মনে করেন, দেশের অর্থনীতিকে যারা খেলো মনে করে, তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১-এর বিচারক মো. আবুল কাশেম এ রায় ঘোষণা করেন। পাশাপাশি তানভীর মাহমুদ ও জেসমিন ইসলামকে ৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতারণার আরেক ধারায় তাদের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২৫ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
এদিন পলাতক আট আসামি বাদে বাকিরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের উপস্থিতিতে দুপুর ১২টা ৬ মিনিটে বিচারক ২৪৮ পৃষ্ঠার রায় সংক্ষেপে পড়া শুরু করেন। এ সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, হলমার্কের ঘটনা দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। যে অপরাধীরা দেশের জনগণের আমানত, দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা, দেশের অর্থনীতিকে খেলো মনে করে তাদের মৃত্যুদণ্ডের মতো সাজা হওয়া উচিত বলে আদালত মনে করেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট আইনে সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। এমতাবস্থায় অপরাধের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। পরে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তানভীর, জেসমিনসহ আট আসামিকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ ছাড়া অন্য ৯ আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত অন্য আসামিরা হলেন প্রতিষ্ঠানটির সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন, জেনারেল ম্যানেজার তুষার আহম্মেদ, ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম রাজা, নকশী নিটের এমডি আব্দুল মালেক এবং টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান। যাবজ্জীবন দণ্ডের পাশাপাশি তাদের ১০ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে। প্রতারণার আরেক ধারায় তাদের সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি ২ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রায়ে সোনালী ব্যাংকের শীর্ষ সাত কর্মকর্তা-প্রধান কার্যালয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবির, সাবেক জিএম ননী গোপাল নাথ, সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সাবেক জিএম মীর মহিদুর রহমান, ডিএমডি মাইনুল হক, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ, এজিএম কামরুল হাসান খান ও সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেছা মেরীকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়েছে। আর প্রতারণার আরেক ধারায় তাদের সাত বছরের কারাদণ্ড, দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকারকে এক ধারায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেক ধারায় দুই বছরের কারাদণ্ড ও ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় তানভীর ও তার স্ত্রীর আইনজীবী শফিকুল ইসলাম বলেন, এ রায় আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৯ ধারায় তানভীর ও জেসমিনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া যুক্তিযুক্ত হয়নি। রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাব, সেখানে তারা খালাস পাবেন বলে মনে করি।
দুদকের আইনজীবী মীর আহম্মেদ সালাম বলেন, আমরা সব আসামির সর্বোচ্চ সাজা প্রত্যাশা করেছিলাম। আদালত ৯ জনের সর্বোচ্চ সাজা দিলেও বাকি আট আসামির বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দিয়েছেন। রায়ে সন্তুষ্ট কি না, এখনই বলা সম্ভব নয়। কমিশনের সঙ্গে আলাপের পর এ বিষয়ে বলা যাবে।
রায় শুনে পালিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যান:
এ মামলার আসামি সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. জামাল উদ্দিন সরকার জামিনে ছিলেন। গতকাল তিনি আদালতে উপস্থিত হন। তাকে পৃথক দুটি ধারায় পাঁচ বছর ও দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। রায় শুনেই তিনি আদালত থেকে পালিয়ে গেছেন।
এ বিষয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. হারুন ওর রশিদ বলেন, রায় ঘোষণার সময় উনি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। রায় শেষে দেখি চলে গেছেন।
আদালতের বেঞ্চ সহকারী রাজিব দে বলেন, জামিনে থাকা আসামি জামাল এদিন হাজিরা দিয়েছেন। রায়ের পর তাকে না পাওয়ায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
এর আগে ২৮ জানুয়ারি আদালত যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য ২৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেন। তবে ওইদিন দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রায় থেকে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে পাঠান। পরে গত ১২ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে রায়ের জন্য ১৯ মার্চ দিন ধার্য করেন।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ভুয়া ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের হিসাবে সুতা রপ্তানির নামে ৫২৫ কোটি ৬২ লাখ ৯২ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের সুতা রপ্তানি করা হয় বলে নথিপত্রে দেখানো হয়। ওই হিসাবে পুরো অর্থ জমা করা হলে তা থেকে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা হলমার্কের আরেক ভুয়া প্রতিষ্ঠান অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়, যা পরে তানভীর ও তার স্ত্রী তুলে নেন। ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে প্রতারণা, জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, পরস্পরের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের অপব্যবহার এবং পাচারের অভিযোগে রাজধানীর রমনা থানায় এ মামলা করে দুদক। ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।