নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সংগঠনকে আরও চাঙ্গা করার কৌশল নিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। সেই লক্ষ্যে শুরুতেই আন্দোলনকেন্দ্রিক হতাশা কাটিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে চায় দলটি। এর অংশ হিসেবে হাইকমান্ডের নির্দেশে জ্যেষ্ঠ নেতারা কারাবন্দি, নির্যাতিত ও সদ্য কারামুক্ত নেতাদের বাসায় যাচ্ছেন। রোজার আাগে থেকে শুরু হওয়া এই কার্যক্রমের মাধ্যমে এসব পরিবার ও নেতাদের দলের সঙ্গে নতুনভাবে যোগাযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। এ ছাড়া ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করে সারা দেশের হতাশাগ্রস্ত নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা ও রাজনীতিতে শামিল করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিএনপি। রমজানের মাঝামাঝি থেকে গুম-খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার নেতাকর্মীদের পরিবারের কাছে আর্থিক উপহার পাঠানো হবে। এর পাশাপাশি সীমিত পরিসরে হলেও কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে থাকছে বিএনপি। সেইসঙ্গে সংগঠন পুনর্গঠনের কাজও চলছে। এসব কারণে নেতাকর্মীদের আনাগোনায় নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল কালবেলাকে বলেন, ‘উজ্জীবিত ভাবটা আমাদের মধ্যে আগেও ছিল। কিন্তু মাঝখানে একটু হোঁচট খাওয়ায় আচমকা একটা অন্য ভাবধারা চলে আসে। সেটা আমরা কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। রমজান মাসকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক তৎপরতা তথা নির্যাতিত-নিপীড়িতরা যাতে তাদের হতাশা ভাব কাটিয়ে উঠতে পারে, সেই চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে সব জায়গা থেকে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত হওয়ার লক্ষণ সব জায়গায় প্রকাশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে সংগঠন পুনর্গঠনও একটি কারণ বটে।’
বিএনপির দাবি, নির্বাচনের আগে গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে দল ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ২৭ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া মামলা ও গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে আত্মগোপনে, নিরাপদ অবস্থানে ছিলেন। তবে নির্বাচনের পর কেন্দ্রীয় এবং তৃণমূলের কারাবন্দি প্রায় অধিকাংশ নেতাই এখন জামিনে মুক্ত। যাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল তারাও এরই মধ্যে জামিন পেয়েছেন। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির নেতারাও দলীয় ও সাংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। নিয়মিত মহানগর বিএনপির কার্যালয়েও যাচ্ছেন। তাদের ঘিরে অন্য নেতাকর্মীরাও সক্রিয় হয়েছেন। ফলশ্রুতিতে মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপিও ধীরে ধীরে চাঙ্গা হচ্ছে।
এদিকে নির্বাচনের পর সংসদ বাতিল এবং একদফা দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ৭ জানুয়ারির ভোট বর্জন করা বিএনপি। সীমিত হলেও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে রয়েছে তারা। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের কর্মসূচির বাইরে ভোটের পর এখন পর্যন্ত পাঁচটি কর্মসূচি পালন করেছে দলটি। এর মধ্যে লিফলেট বিতরণ ও কালো পতাকা মিছিল ছিল। এসব কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে।
গত শনিবার দুপুরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও শ্রম বিষয়ক সহসম্পাদক হুমায়ূন কবিরের মুক্তির দাবিতে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের মানববন্ধন ছিল। এর আগে গত ৯ মার্চ একই স্থানে লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগের কর্মসূচি করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি।
বিএনপি নেতারা বলছেন, নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি এই দুটি সাধারণ কর্মসূচিকেও বড় সমাবেশে রূপ দিয়েছে। এ ছাড়া ছাত্রদলের নতুন কমিটি দেওয়ার পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থিত অঙ্গ-সংগঠনের কার্যালয়গুলোতে উপস্থিতি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। নেতাকর্মীরা নিয়মিত দলীয় কার্যালয়ে যাচ্ছেন, শোডাউন করছেন। অন্যদিকে দলীয় কার্যালয়ে সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত ব্রিফিং করছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। এ কারণেও নেতাকর্মীদের আনাগোনা বেড়েছে। সব মিলিয়ে দলীয় কার্যালয় এখন সরগরম। এটিকে বিগত আন্দোলন ব্যর্থতায় অনেকটাই ‘ব্যাকফুটে’ চলে যাওয়া বিএনপির ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ বলে অনেকে মনে করছেন।
এদিকে রমজানে এবার তৃণমূল পর্যায়ে ইফতার মাহফিলে জোর দিচ্ছে বিএনপি। সারা দেশে মহানগর, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ে পাঁচ শতাধিক ইফতার পার্টি আয়োজন করা হচ্ছে। ঢাকায়ও হচ্ছে ওয়ার্ডভিত্তিক ইফতার। দলের সদ্য কারামুক্ত নেতৃবৃন্দের নিয়ে অনুষ্ঠিত এসব ইফতারে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের হতাশা কাটিয়ে সংগঠনকে গতিশীল ও উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে বিএনপি। সম্প্রতি দলের কেন্দ্রীয় সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ বরিশালে তার নিজ এলাকায় একটি ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেন, যেখানে দলের সদ্য কারামুক্ত নেতাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। জানা গেছে, আন্দোলনের পর নেতাকর্মীদের উৎসাহিত করতে দলের হাইকমান্ড ৮২টি সাংগঠনিক জেলার ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতিদিন তিনি চার থেকে পাঁচটি জেলায় একত্রে সংযুক্ত হবেন।
বিএনপির নেতাকর্মীরা এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেননি উল্লেখ করে দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা গত অক্টোবর থেকে ফেরারি জীবনযাপন করছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচি দূরে থাক—তারা এলাকায় থাকতে পারছেন না, পারিবারিক ও কর্মজীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা এবং আবার রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় শামিল করার উদ্যোগ নিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন ও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির প্রতিবাদে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে লিফলেট বিতরণ করেছি, বিক্ষোভ সমাবেশ করেছি। এখন ইফতার মাহফিলের মধ্য দিয়ে সেই বক্তব্য তুলে ধরছি, নেতাকর্মীদের তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা দিচ্ছি। এটি শুধু ইফতার মাহফিল নয়, এর মধ্য দিয়ে আমাদের কর্মিসভা, সাংগঠনিক মিটিংও হয়ে যাচ্ছে। ফলে ইফতার মাহফিলগুলো নেতাকর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হচ্ছে।’
রমজান উপলক্ষে কোথাও কোথাও হতদরিদ্র মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রীও বিতরণ করা হচ্ছে। গত কয়েকদিনে মুন্সীগঞ্জ-২ (লৌহজং ও টঙ্গীবাড়ী) এর কলমা ইউনিয়নে হতদরিদ্রের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা বিএনপির সভাপতি ইমরানুল হক চাকলাদার। রমজানজুড়ে এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।
এদিকে বরাবরের মতো এবারও আন্দোলন-সংগ্রামে গুম-খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার সহস্রাধিক পরিবারের কাছে দলের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। তবে উপহার সামগ্রীর পরিবর্তে এবার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে, যা মধ্য রমজান থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেন, ‘বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে গত সাত বছর ধরে আন্দোলন-সংগ্রামে গুম-খুন ও পঙ্গুত্বের শিকার পরিবারগুলোর কাছে ঈদ উপহার সামগ্রী কিংবা আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছি। আগামীতেও এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।’