সাভারের সাইফুল ইসলাম ও রায়না ইসলামের তালাক হয় ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি। তালাকের পর রায়না ইসলাম তাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে চলে যান বাপের বাড়ি। ফোনেও কথা বলতে পারেন না—এমন অভিযোগে কন্যাসন্তানের অভিভাবকত্ব চেয়ে আদালতে মামলা করেন সাইফুল। ২০২০ সালের ১৫ জুলাই করা ওই মামলা এখনো বিচারাধীন। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতে আগামী ২৭ জুন এ মামলার বাদীর সাক্ষ্যের জন্য দিন ধার্য রয়েছে। হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী, এ মামলার বিচার শেষ হওয়ার কথা ছিল মামলা দায়েরের ছয় মাসের মধ্যে। কিন্তু তা হয়নি। মানা হয়নি উচ্চ আদালতের আদেশ।
একইভাবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, দুদক আইন এবং ফৌজদারি আইনে করা মামলার বিচার শেষ করার জন্য সময়সীমা বেঁধে দিয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছেন উচ্চ আদালত। শুধু বিচার শেষ করতেই নয়, বিচারে যাতে বিলম্ব না হয়, সে বিষয়ে দেওয়া হয়েছে নির্দেশনা। বিচার শুরুর পর কোনো মুলতবি ছাড়াই একটানা শুনানি করা, কিছু মামলায় বিচারে বিলম্ব হলে তার ব্যাখ্যা সুপ্রিম কোর্টের কাছে দাখিল করা, বিচার বিলম্বের বিষয়টি মনিটরিং করাসহ অনেক নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু উচ্চ আদালতের এসব নির্দেশনার বাস্তবায়ন নেই।
জানতে চাওয়া হলে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নে সবাই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ নির্দেশনা অমান্য করেন না। হয়তো সাক্ষী হাজির হলো না, তাহলে বিচারক কী করবেন? আবার পুলিশ বাসায় গিয়েও হয়তো সাক্ষীকে পাচ্ছে না, তাহলে পুলিশ কী করবে? বাস্তবতার কারণে অনেক সময় নির্দেশনাগুলোর বাস্তবায়ন হচ্ছে না।’
মামলাজটের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ কমাতে এবং দ্রুত মামলা শেষ করতে হলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (এডিআর) ব্যবস্থা চালুর কোনো বিকল্প নেই। আইনের সংশোধন করে কার্যকরভাবে এডিআর চালু করতে হবে। তাহলেই কেবল মামলার জট কমানো সম্ভব হবে।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিচার বিভাগে এখন দুর্ভোগের শেষ নেই। বছরের পর বছর এই দুর্ভোগ চলছে। মামলাজট আর বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা এখন প্রায় ৪১ লাখ। বিচারপ্রার্থীদের এমন দুর্ভোগ দেখে উচ্চ আদালত থেকে জারি করা হয়েছে অনেক নির্দেশনা। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের আওতায় হাইকোর্ট নিম্ন আদালতের প্রতি এসব নির্দেশনা জারি করে থাকেন। সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিম্ন আদালতগুলোকে হাইকোর্ট নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি করবেন। হাইকোর্ট এই বিশেষ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন বিভিন্ন মামলার রায়ের মাধ্যমে।
জানা যায়, বিএনপি নেতা প্রয়াত মওদুদ আহমদ এক-এগারোতে তার বিরুদ্ধে করা সম্পদের অসংগতি মামলার বিচার কার্যক্রম যাতে না চলে, সেজন্য হাইকোর্টে যান। ২০১৯ সালের গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি ওবায়দুল হাসান (বর্তমান প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে তিনি তার আয়কর মূল্যায়ন (২০০২-২০০৮) মামলার শুনানিতে অংশ নেন। তখন তিনি হাইকোর্টে দায়ের করা তার ৯টি রিট মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম স্থগিত রাখার আরজি জানান।
একই বছরের ৮ এপ্রিল ওই বেঞ্চ এই মামলায় একটি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ দেন। হাইকোর্ট বলেন, ‘নিম্ন আদালতের বিচারকদের অনেকের মধ্যে ধারণা আছে যে হাইকোর্ট যেখানে কোনো আদেশ মানতে সময়সীমা বেঁধে দেন অথচ সেটা মানতে না পারলে কী হবে, তা বলে দেন না, তাই সেসব আদেশ নির্দেশনামূলক, বাধ্যতামূলক নয়। এই ধারণা ভুল।’
হাইকোর্ট আরও বলেন, ‘আদেশ মানতেই হবে। সময়সীমা মানতে না পারলে যথাযথ কারণ ব্যাখ্যা করে হাইকোর্টকে অবগত করতে হবে। কিন্তু নীরব থাকলে বিভাগীয় শাস্তিমূলক মামলার মুখোমুখি হতে হবে।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু এই একটি নির্দেশনার বাস্তবায়ন ঘটলেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, দ্রুত বিচার আইন, দুর্নীতি দমন আইনসহ বেশ কয়েকটি বিশেষ আইনে করা মামলার বিচার দ্রুত শেষ করা সম্ভব হতো। কারণ, বিশেষ আইনগুলোতে মামলা নিষ্পত্তির সুনির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ রয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ২০(৩)-এ সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মামলা বিচারের জন্য নথি প্রাপ্তির তারিখ থেকে ১৮০ দিনের (ছয় মাস) মধ্যে বিচারকাজ সমাপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া ধারা ২০(২)-এ বলা হয়েছে, মামলার শুনানি শুরু হলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি কর্মদিবসে একটানা পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে বিচার শেষ করতে না পারলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে হবে। একইভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালকে ৯০ দিনের মধ্যে বিচার, না পারলে সুপ্রিম কোর্টের কাছে কারণ দর্শিয়ে প্রথমে ৩০ দিন ও পরে আরও ১৫ দিনে বিচার শেষ করার বিধান করা আছে। এ ছাড়া ১৯৫৮ সালের ‘দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’র ৬(ক) ধারা অনুযায়ী, দুর্নীতি মামলা আমলে নেওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার কথা।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টর আপিল বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি থাকাকালে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন অধস্তন আদালতের প্রতি। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণ ও ধর্ষণ-পরবর্তী হত্যা মামলা নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে শেষ করা, শুনানি শুরু হলে প্রতি কার্যদিবসে টানা মামলা পরিচালনা করা, মামলায় সাক্ষীর উপস্থিতি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে ছয় দফা নির্দেশনাসহ অভিমত দেন হাইকোর্ট। ২০১৯ সালের ২১ জুলাই বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে ওই আদেশ দেন।
একই বেঞ্চ একই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি দায়রা আদালতগুলোতে ১০ বছর আগের বিচারাধীন সব ফৌজদারি মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে এই সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতেও বলা হয়। প্রত্যেক জেলা জজকে ৩০ দিনের মধ্যে এসব মামলার তালিকা করে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে পাঠতে বলা হয়। তালিকা রেজিস্ট্রারের হাতে পাওয়ার পর রেজিস্ট্রার জেনারেল তা সুপ্রিম কোর্টের অধস্তন আদালত তদারকি কমিটির কাছে জমা দেবেন বলে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়। ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতের মামলাগুলো ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সন্তানের হেফাজত নিয়ে করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রায় দেন। রিটটি নিষ্পত্তি করে দেওয়া রায়ে আদালত বলেন, সন্তানের অভিভাবকত্ব নিয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা হচ্ছে। তবে দুই থেকে তিন বছর পার হলেও মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না, যা দুঃখ ও হতাশাজনক।
‘তদারকিতে নেই মনিটরিং সেল’: ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের (বর্তমানে আপিল বিভাগের বিচারপতি) নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার বিচার তদারকিতে মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশ দেন। সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এ সেল গঠন করতে বলা হয়। রায়ে বলা হয়, এ মনিটরিং সেলের কাজ হবে ৬ মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি না হওয়া নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার বিষয়ে বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তার পাঠানো প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অধস্তন আদালত সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের কমিটির কাছে প্রতিবেদন দেবে। প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপ্রিম কোর্টের ওই কমিটি মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৩১(ক)(৩) ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেবে। মূলত ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলার তদন্ত ও বিচারে গতি আনতেই এ নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। কিন্তু ওই রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র ওই রায় বাস্তবায়নের নির্দেশনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ অক্টোবর হাইকোর্টে একটি রিট করে। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৮ নভেম্বর তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. আলী আকবরকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়। কিন্তু ওই সেল গঠনের পর আর কোনো কার্যক্রম এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়।
‘জনস্বার্থ’-এর রায় তদারকিতেও হয়নি মনিটরিং সেল’: ‘কার্যকর’ আইন থাকার পরও বারবার ফুটপাত অবৈধ দখলে চলে যাওয়ায় ২০০১ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘জনস্বার্থে’ বেশ কিছু নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের তৎকালীন বিচারপতি আবু সাঈদ আহাম্মেদ ও বিচারপতি খাদেমুল ইসলাম চৌধুরী ওই রায়ে জনস্বার্থের সব রায় ও আদেশ বাস্তবায়নে এই তদারকি সেল গঠন করতে বলেন। রায়ে বলা হয়, ‘ভারতে জনস্বার্থে দায়ের করা মামলার রায় তদারকি করতে একটি সেল খোলা হয়েছে। একই ধরনের মামলায় দেওয়া আদেশ বাস্তবায়নে যথাযথ দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেটি আমাদের দেশে হয়নি। প্রধান বিচারপতি দয়া করে জনস্বার্থে দেওয়া (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) উচ্চ আদালতের রায় ও আদেশ বাস্তবায়ন নজরদারি করতে একটি তদরকি সেল গঠনে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশনা দেবেন।’ কিন্তু সেল গঠনসহ ওই রায়ের নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি’র) প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ কালবেলাকে বলেন, ‘উচ্চ আদালত আদেশ দিলে সেটা সবাই মানতে বাধ্য। ছয় মাসে মামলা শেষ করতে হবে, এটা আইনে না থাকলে হয়তো উচ্চ আদালত এমন আদেশ দিতেন না। ছয় মাসে বিচার শেষ করা সম্ভব বলেই হয়তো আইনপ্রণেতারাও এমন আইন করেছেন। তবে এটা মানা বাধ্যতামূলক কি না, তা আইনে উল্লেখ নেই। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ নজির অনুযায়ী আইনে মামলা শেষ করার জন্য উল্লিখিত সময়সীমা মানা বাধ্যতামূলক নয়। এতে করে বিচারকরা ধরে নেন, ওইসব সময়সীমা মানা বাধ্যতামূলক নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘আদালতের নজির, রায়ের মাধ্যমে দেওয়া নির্দেশনা এবং আইনের নির্দেশনা নিয়ে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে। আইনের নির্দেশনা মানা সম্ভব না হলে আইন সংশোধন করতে হবে। যে আইন বাস্তবায়ন সম্ভব না, সেটা সরকার করে কেন? তা ছাড়া কারও কারও মামলা তো দুই মাসেই নিষ্পত্তি হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সাধারণ একজনের মামলা অর্ধযুগ-একযুগেও শেষ হচ্ছে না। বড় কথা হচ্ছে, সক্ষমতা বাড়ানো। মামলা জট কমাতে হলে আইন ও রায়ের নির্দেশনা পালন করতে হলে বিচারক বাড়াতে হবে। বিচার বিভাগের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।’