জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:১৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ

ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছে মানুষ

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভোটবিমুখ হয়ে পড়ছেন নাগরিকরা। সরকারবিরোধীদের বর্জন, একতরফা নির্বাচন, দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী, সহিংসতা, ভোটের মাঠে প্রভাব বিস্তার, ফলাফলে আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে ভোটে আগ্রহ হারাচ্ছেন ভোটাররা। এটিকে গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে আখ্যায়িত করছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এ থেকে উত্তরণে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলগুলোকেই ভূমিকা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনিয়মের কারণে দুবার উপনির্বাচন হওয়া গাইবান্ধা-৫ আসনে যে ভোট পড়েছে, তার চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ কম ভোট পড়েছে বুধবার ভোট হয়ে যাওয়া ৬ আসনের উপনির্বাচনে। গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে এই ৬ আসনে গড় ভোট পড়েছে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। তবে এ কমিশনের অধীনে এর আগে ফরিদপুর-২ আসনে ভোট পড়েছে ২৬ দশমিক ২৭ শতাংশ।

আর সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে। মাত্র ১৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ৪৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এ ছাড়া বগুড়া-৪ আসনে ভোট পড়েছে ২৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। বগুড়া-৬ আসনে ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে ভোট পড়েছে ৩৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।

এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ওই দিন ভোট পড়ার হার ছিল ৫.২৮ শতাংশ। তারও আগে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমের ব্যাপক প্রচারের মধ্যে ভোটারের খরা দেখেছিল ঢাকার দুই সিটির নির্বাচনে। সেবার দক্ষিণ সিটিতে ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ভোটের হার ছিল ২৫.৩ শতাংশ।

এদিকে, বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের উপনির্বাচনে কম ভোট পড়ার পেছনে তিন কারণ উদ্ঘাটন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমত, বিএনপির দখলে থাকা আসনগুলোতে ভোটে নেই বিএনপিই। দ্বিতীয়ত, উপনির্বাচনে ভোট একটু কম কাস্ট হয়। তৃতীয়ত, এই ভোটে সংসদ সদস্যদের মেয়াদকাল কম হওয়ায় ভোটার আগ্রহ পান না বলে মনে করছে ইসি।

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে ইসির কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘ঠাকুরগাঁওয়ে ভোটার উপস্থিতি ভালো। চাঁপাইনবাবগঞ্জে যেটা সেটাও ভালো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটু কম। বগুড়ায় কম।’

বগুড়ার প্রসঙ্গ টেনে এই কমিশনার আরও বলেন, ‘বগুড়া বিএনপির দুর্গ। এটা সবাই জানেন। ওখানে বেশিরভাগ ভোটার বিএনপির। বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে আসেনি সংগত কারণেই ওখানে বিএনপির ভোটাররা আসেননি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও একই ব্যাপার। বিএনপি যেহেতু আসেনি। একটা বড় দল ওখানেও তাদের সমর্থন আছে। সেই সমর্থকগুলো ভোট দিতে আসেনি।’

উপনির্বাচনে ভোট কাস্টিং কম হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সংসদ সদস্যদের মেয়াদকাল খুব কম, আট মাস নয় মাস। এই অল্প সময়ের জন্য আসলে ভোটাররা ইন্টারেস্ট বোধ করে না।’ তবে ভোটের এই উপস্থিতি নিয়ে নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট বলেও জানান এই কমিশনার।

নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই ভোটবিমুখ হওয়া শুরু হয় নাগরিকদের। বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধীদের বর্জনের মুখে ওই বছর ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় এ নির্বাচন। যা নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এরপর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনের আগের রাতে বিভিন্ন এলাকায় ভোট হয়ে যাওয়ার কথা উঠে আসে বিভিন্ন মাধ্যমে। নানা আশ্বাসের পর বিএনপি জোট এ নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রশাসনের সহযোগিতায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীনরা রাতের অন্ধকারে ব্যালটে সিল মেরে বাক্সভর্তি করে রাখে বলে অভিযোগ আসে। যা নিয়ে এখনো তীর্যক মন্তব্য হজম করতে হয় ক্ষমতাসীনদের। এর পরই ভোটারদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়।

জাতীয় সংসদ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা যায়। বিরোধীদের বর্জনের মুখে সিটি করপোরেশন, উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল মনোনীত প্রার্থীদের শক্তি প্রদর্শন এবং অনেক জায়গায় ফলাফলে প্রভাব বিস্তারের কারণে দিন দিন আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে। গত ১২ অক্টোবর প্রথমবার গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখে খানিকটা হতাশ হয় নির্বাচন কমিশন। সবগুলো কেন্দ্র ঢাকা থেকে সিসি ক্যামেরায় পর্যবেক্ষণ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের কেন্দ্র দখলের চিত্র স্বচক্ষে দেখতে পান সিইসিসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা। পরে নানা অনিয়মের অভিযোগে ওই ভোট বাতিল করে সব কেন্দ্রে পুনরায় ভোট গ্রহণ করা হয়। ৪ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়ে। সর্বশেষ বুধবার অনুষ্ঠিত বিএনপি এমপিদের ছেড়ে দেওয়া ৬ আসনের উপ নির্বাচনে হতাশাজনক ভোটার উপস্থিতি নজর কাড়ে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের। এ নির্বাচনেও গড়ে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট পড়েছে বলে জানায় নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী থাকলে ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে আসেন। সেজন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহাদাত হোসেন চৌধুরী (অব.) কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়া মোটেও সুখকর ব্যাপার নয়। ভোটার উপস্থিতি নির্ভর করছে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। বড় দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা না হলে, সমঝোতা না থাকলে তারা অংশ না নিলে ভোটাররাও আসে না এবং আসবেও না। বড় দল অংশ না নিলে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে। এটি রাজনীতিকদেরই সমাধান করা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন বর্জনের সংস্কৃতি দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে নির্বাচনই ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ। বড় দল অংশ নিলে এবং মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলে ভোটাররাও ভোট উৎসব করে। সেজন্য ভোটকে উৎসবে পরিণত করতে হলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে হবে।’

নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, ‘ভোটাররা ভোটে আগ্রহ হারালে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। ভোটার ছাড়া ভোটকে লেজিটেমিট বলা যায়না। আর এটি তিন কারনে হয়ে থাকে। প্রথমত: সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে ভোটে মানুষের আগ্রহ কমে যায়। তারা কেন্দ্রে যায়না। পছন্দের দলগুলো অংশ নিলে সাধারণ ভোটাররও কেন্দ্রে যাবে। নইলে তারা কেন্দ্রে যেতে চায়না। দ্বিতীয়ত, অনেক ভোট বিশেষ করে উপ নির্বাচনগুলো সরকার পরিবর্তনের নির্বাচন নয়। মানুষ মনে করে ভোট দিলে কী হবে। সরকারতো আর পরিবর্তন হবে না। সেজন্য তারা কেন্দ্রে যেতে চায়না। তৃতীয়ত, নির্বাচন কমিশন তথা আয়োজকরা যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের নিশ্চয়তা এবং প্রশাসন ভোটের পরিবেশ ও নিরাপত্তা বিধান না করে তাহলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে চায় না। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনেরও দায় থাকে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

দুর্ঘটনার কবলে ইসরায়েলি নিরাপত্তামন্ত্রী

প্রেমের জন্য দিনটি ভালো

নরসিংদীতে হিটস্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু 

রাজধানীর যেসব এলাকায় আজ গ্যাস থাকবে না

বৃষ্টিতে ভিজল সিলেট

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

ইতিহাসের এই দিনে আলোচিত যত ঘটনা

সকাল ৯টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

২৭ এপ্রিল : আজকের নামাজের সময়সূচি

গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে আজ

১০

নাটোরে অপহরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ৭

১১

ছাত্র ইউনিয়নের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত 

১২

ভোটদানের শর্তে কোরআন ছুঁয়ে টাকা নেওয়ার কল রেকর্ড ভাইরাল

১৩

‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে’

১৪

 ছেলের কিল-ঘুষিতে শিক্ষক পিতার মৃত্যু

১৫

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুনের ১০ বছর আজ

১৬

‘ভয়াল ২৯ এপ্রিল, ১৯৯১ স্মরণ ও প্যারাবন নিধন প্রতিবাদ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত

১৭

শাহ আমানতে ৯০ হাজার দিরহামসহ যাত্রী আটক

১৮

আবুধাবিতে চালু হচ্ছে উড়ন্ত ট্যাক্সি, ৩০ মিনিটেই দুবাই

১৯

গরু চোরাচালানে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ও জনপ্রতিনিধি

২০
*/ ?>
X