কোনোরকম প্রশিক্ষণ না থাকলেও অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে বিপুলসংখ্যক মানুষ। সরকারের কাছ থেকে অনুমতি (লাইসেন্স) নিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র বহন করলেও ন্যূনতম ব্যবহারিক জ্ঞান নেই অনেকেরই। এমনকি এগুলো কীভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়—সে সম্পর্কেও অধিকাংশের নেই স্পষ্ট ধারণা। এ অজ্ঞতার কারণেই লাইসেন্সধারীদের বৈধ অস্ত্রে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, দেশে ৭০ হাজারের বেশি বিভিন্ন ধরনের বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। ডিজিটাল আর্মস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের তথ্যানুযায়ী, এসব অস্ত্রের মধ্যে ডাটাবেজে এখন পর্যন্ত যুক্ত হয়েছে ৫০ হাজার অস্ত্রের তথ্য। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স আছে ৪৫ হাজার। বাকিগুলো আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে।
জানা গেছে, দেশে সামরিক বা বেসামরিক যে কোনো নাগরিককে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে ১৮৭৮ সালের আর্মস অ্যাক্ট, ১৯২৪ সালের আর্মস রুলস আইন এবং আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬ অনুসরণ করা হয়।
একজন ব্যক্তি শর্ত মেনে অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করেন। সেই আবেদনটি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) তদন্ত করে আবেদনকারীর দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেয়। এরপর জেলা প্রশাসক (জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) অনুমোদন দিয়ে সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয় অনাপত্তিপত্র দিলে জেলা প্রশাসক সাক্ষাৎকার নিয়ে ওই আবেদনকারীর নামে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যু করেন। আবেদনকারীর হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার আগে তাকে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।
যদিও লাইসেন্স নেওয়ার সময় অন্যান্য শর্তের সঙ্গে আবেদনকারীর অস্ত্র পরিচালনা সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান আছে কি না, সেই প্রশ্নে ইতিবাচক উত্তর দিতে হয়! কিন্তু অস্ত্র চালানোর সেই প্রাথমিক জ্ঞান কোথায় পেলেন—সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।
আবেদনকারীর শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য, আবেদন করা অস্ত্র এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জ্ঞান ও অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাক্ষাৎকার নেন। তাতে সন্তুষ্ট হওয়ার পর লাইসেন্স ইস্যু করা হয়। তবে শারীরিক, মানসিক সামর্থ্য এবং অস্ত্র রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে যেসব তথ্য দেওয়া হয়, তা যাচাইয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের কোনো বিশেষজ্ঞ যুক্ত থাকেন না।
অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে কর্মরত এবং অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও অস্ত্রের ব্যক্তিগত লাইসেন্স নিতে পারেন। শুধু তারাই প্রশিক্ষিত তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান রয়েছে। বাকি লাইসেন্সধারী বৈধ অস্ত্রধারীদের অস্ত্র চালনা বা রক্ষণাবেক্ষণে ন্যূনতম ব্যবহারিক জ্ঞান নেই। অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার পরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণের ব্যবস্থা বা সুযোগ নেই।
পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার নীতিমালা-২০১৬-এ শুধু আত্মরক্ষার স্বার্থে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এতে প্রশিক্ষণ বা অস্ত্র পরীক্ষা করতে ‘টেস্ট ফায়ারের’ কথা নেই। নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু নতুন কেনা অস্ত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে লাইসেন্সধারী ‘টেস্ট ফায়ার’ করতে পারবেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যমান আইন ও নীতিমালায় নির্ধারিত পরিমাণ আয়কর আর কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়া যায়। এরপর অস্ত্র কিনে ব্যবহার শুরু করেন লাইসেন্সধারী। এ অস্ত্র কীভাবে চালাতে হবে, রক্ষণাবেক্ষণের উপায় কী, তার বিস্তারিত ব্যবহারিক জ্ঞানের কোনো প্রয়োজন হয় না বা সুযোগও নেই। ব্যবহারিক জ্ঞান না থাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্ত অস্ত্রধারীরা প্রায়ই ঘটাচ্ছেন দুর্ঘটনা। গুলিতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, লাইসেন্স পাওয়ার পর সেই অস্ত্র দিয়ে কোনো অঘটন ঘটলে এর দায় লাইসেন্সধারীর। লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে তা বাতিলসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তবে ন্যূনতম ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়া অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া এবং পরবর্তীকালে অস্ত্র কিনে ব্যবহারের বিদ্যমান ব্যবস্থাটি ত্রুটিপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট নীতিমালায়ও বিষয়টি অস্পষ্ট। কারণ মুখস্থ কিছু প্রশ্নে উত্তর দিয়ে লাইসেন্স পেয়ে অস্ত্র কেনেন লাইসেন্সধারী। এরপর সেই অস্ত্র কীভাবে চালাতে হবে, নির্ধারিত অস্ত্রটির সেফটি ফিচার কী, রক্ষণাবেক্ষণ কীভাবে করতে হয়, সেগুলো জানা জরুরি। সরকার শুধু লাইসেন্স দিয়েই দায় সারছে।
এ বিষয়ে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘লাইসেন্স দেওয়ার আগে অস্ত্র চালানোর বিষয়ে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ থাকা উচিত। অস্ত্রটি কীভাবে হ্যান্ডেল করবে, কীভাবে গুলি ছুড়বে, কীভাবে পরিষ্কার করবে, কীভাবে ধরবে, পরিবারের কেউ হাত দিতে পারবে কি না, অন্য কেউ চালাতে পারবে কি না—এসব বিষয় সম্পর্কে হাতেকলমে জ্ঞান থাকা দরকার।’
তিনি বলেন, ‘লাইসেন্স দেওয়ার আগে ন্যূনতম প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই হয়নি।’
পুলিশের সাবেক এ সর্বোচ্চ কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণত বাহিনীগুলোতে প্রশিক্ষণের সময় বলা হয়, অস্ত্রে হাত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মনে করতে হবে এটা লোডেড। এটা খুবই বেসিক কথা। কিন্তু বাহিনীর বাইরে ব্যক্তিপর্যায়ে যাদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, তারা এটি জানেন না। তাদের ন্যূনতম প্রশিক্ষণ নেই। এসব কারণে দুর্ঘটনাবশত আহত-নিহতের ঘটনা আমরা দেখছি।’
জানা গেছে, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীতে ছয় মাসের মৌলিক প্রশিক্ষণে প্রচলিত অস্ত্রগুলোর ব্যবহার হাতেকলমে শেখানো হয়। এ ছাড়া প্রতি বছর ফায়ারিং প্র্যাকটিস হয়। তারপরও রক্ষণাবেক্ষণ ও অন্যান্য সময় দুর্ঘটনা ঘটে। যাদের কোনো প্রশিক্ষণ বা হাতেকলমে জ্ঞান ছাড়াই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়, তাদের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।
গত দুই বছরের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স নিয়েছেন এমন অন্তত ১০ ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৈধ প্রক্রিয়ায় লাইসেন্স পাওয়ার আগপর্যন্ত অস্ত্র চালানোর সুযোগ নেই। লাইসেন্স পাওয়ার আগে বা পরে তারা অস্ত্র চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণে প্রশিক্ষণ পাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে লাইসেন্সপ্রাপ্ত একজন কালবেলাকে বলেন, অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ডেকে নিয়েছিলেন। নানা বিষয়ে কথা বলেছেন, কিন্তু এর কিছুই অস্ত্র চালানো বা ব্যবহার বিষয়ক নয়। ওই সাক্ষাতের পর কিছুদিনের মধ্যেই লাইসেন্স পেয়েছি। তিনি বলেন, ‘লাইসেন্স পেয়ে অস্ত্র কেনার আগপর্যন্ত বৈধ কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অস্ত্র চালানোর জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পাইনি। কোনো সুযোগ আছে কি না, তাও জানি না।’
আগ্নেয়াস্ত্রের নীতিমালায় বলা আছে, ‘শুধু আত্মরক্ষা ও টার্গেট প্র্যাকটিসের উদ্দেশ্যে গুলি ব্যবহার করা যাবে।’
নিয়ম অনুযায়ী বৈধ অস্ত্রধারী ব্যক্তি আত্মরক্ষার জন্য কখনো গুলি ব্যবহার করলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানায় জিডি করতে হবে। সরকারের অনুমোদিত ফায়ারিং রেঞ্জ এবং বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের নির্দিষ্ট অনুশীলন কেন্দ্র ছাড়া টার্গেট প্র্যাকটিস করা যাবে না।
তবে বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের ম্যানেজার দেবাশীষ ঘোষ কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে সাধারণ কোনো লাইসেন্সধারীর শুটিং প্র্যাকটিস করার সুযোগ নেই। ফেডারেশনে শুধু সদস্যরা প্র্যাকটিস করতে পারেন।’
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি বছরই বৈধ অস্ত্রের গুলিতে আহত বা নিহত হওয়ার মতো গুরুতর ঘটনা ঘটছে। গত বছর ৩০ জুলাই বেইলি রোডের একটি ফ্ল্যাটে মানিক নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হন। ওই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে অস্ত্রের মালিক ইসমাইল হোসেন বাচ্চু দাবি করেছিলেন, অস্ত্রটি নাড়াচাড়া করতে গিয়ে গুলি বেরিয়ে গেছে। কীভাবে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়, তা তিনি জানতেন না।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে সিলেটের ওসমানীনগরে লাইসেন্স করা দোনলা একটি বন্দুক পরিষ্কারের সময় গুলি বেরিয়ে ছয় বছরের শিশু নিহত হয়। একই বছরের অক্টোবরে রংপুর সিটি করপোরেশনের (রসিক) মেয়রের কার্যালয়ে জেলা মোটর মালিক সমিতির তৎকালীন সভাপতি মোজাম্মেল হকের পিস্তল থেকে হঠাৎ গুলি বেরিয়ে যায়।
২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশাল সদর আসনের তৎকালীন সাংসদ জেবুন্নেসা আফরোজের লাইসেন্স করা শটগান থেকে বের হওয়া গুলিতে আহত হন তার মামাতো ভাই সাইদুর রহমান।
আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদান, নবায়ন ও ব্যবহার বিষয়ে ২০১৬ সালের নীতিমালা অনুযায়ী, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনকারীর সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় নির্ধারিত ফরমে উত্তরগুলো লিপিবদ্ধ করবেন। এ ফরমে ১৬টি বিষয়ে তথ্য নেওয়া হয়। ক্রমিক ১ থেকে ৮ পর্যন্ত আবেদনকারীর ব্যক্তিগত তথ্য (নাম, পিতার নাম, মাতার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা, বয়স, পেশা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা)। এরপর ধারাবাহিকভাবে আবেদনকারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, অস্ত্র পরিচালনা সম্পর্কিত প্রাথমিক জ্ঞান, অস্ত্র আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে ধারণা, আগ্নেয়াস্ত্র নিরাপদ হেফাজতে সংরক্ষণ করার জ্ঞান ও সক্ষমতা, আগ্নেয়াস্ত্রের আবশ্যকতা, আচার-আচরণ ইত্যাদি তথ্য দিতে হয়।
বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্স ইস্যুর এখতিয়ার মূলত জেলা প্রশাসকের। অন্তত চারজন জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় কোথাও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নেই।
টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা একটি ফরম দিয়ে থাকি। সেটা পূরণ করে দেওয়া হয়। পুলিশের মাধ্যমে আবেদনকারী সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। আবেদনকারীকে লাইসেন্স দেওয়ার আগে অনেক জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। অস্ত্র সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকলে পরে উত্তর দিতে পারেন। প্রশ্নগুলো জবাব যথোপযুক্তভাবে দিতে পারলে এবং মানসিকভাবে উতরাতে পারলেই তার আবেদনটি গ্রহণ করা হয়।’
লাইসেন্স দেওয়ার এ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে তথ্যানুসন্ধানের জন্য যেসব প্রক্রিয়া অনুসরণ করার কথা, বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের সময় সেগুলো সঠিকভাবে হয় না। মূলত আবেদনকারীদের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই তা হয় না।’