কালবেলা প্রতিবেদক
প্রকাশ : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০২:৫৫ এএম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুরাদের কোচিং সেন্টারই ছাত্রী নিপীড়ন কেন্দ্র!

দুদিনের রিমান্ডে
মুরাদের কোচিং সেন্টারই ছাত্রী নিপীড়ন কেন্দ্র!

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার পাশেই শাখার গণিত শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারের কোচিং সেন্টার। সেজন্য স্কুলের পাশের ভবনের তিন তলায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন। দুটি কক্ষে কোচিং করালেও বাকিটি ছিল তার বিশ্রামাগার। কিন্তু শিক্ষকের সে বিশ্রামাগার মাঝেমধ্যেই মৃত্যুপুরী হয়ে উঠত কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য। কথার জালে ফাঁসিয়ে সেখানে নিয়ে যৌন নিপীড়ন চালাতেন মুরাদ। শিশু শিক্ষার্থীরা অস্বস্তি প্রকাশ করলে তাদের বোঝাতেন ‘বাবার বয়সী, তাই আদর করছি’। দীর্ঘদিন ধরেই এ অপকর্ম করে আসছিলেন। মুরাদ হোসেনের সঙ্গে স্কুল গভর্নিং বডির একটি সিন্ডিকেট জড়িত থাকায় ভয়ে এতদিন মুখ খোলেননি ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হন কয়েক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক। তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসেন বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও।

সরেজমিন জানা যায়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখা যে ভবনে, তার একটি ভবন পরেই ৯তলা একটি ভবন। রাস্তা থেকেই সেখানে টানানো বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টারের ফেস্টুন চোখে পড়ে। ছোট একটি গেট দিয়ে ঢুকলে কেয়ারটেকার কামরুল ইসলাম ভবনের ভেতর দিয়ে আরেকটি ভবনের তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। সেখানেই বাঁ পাশের প্রথম ফ্ল্যাটটি মুরাদ হোসেন সরকারের কোচিং।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভাড়া করা ওই ফ্ল্যাটে মাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কোচিং করান তিনি। তিন কক্ষের মধ্যে দুটিতে পাঠদান চলে। ফ্ল্যাটের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রথম কক্ষটি কিছুটা বড়। মাঝখানেরটি তুলনামূলক ছোট। একদম শেষ মাথার কক্ষটিতে গুটিকয় বেঞ্চ রাখা। কোচিংয়ে ক্লাস নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে গেলে সেখানেই বিশ্রাম নিতেন শিক্ষক মুরাদ। এখানেই কৌশলে শিশু শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানি করতেন।

ভিকারুননিসার আজিমপুর শাখার অভিভাবকদের অভিযোগ, কোচিং সেন্টারের ভেতরটি অন্ধকার। বিশেষ করে বিশ্রামের কক্ষটি। সেখানে বাচ্চাদের নানাভাবে হয়রানি করতেন। তবে সবাই তার লক্ষ্যবস্তু ছিল না। পুরো ব্যাচে চটপটে ও সুন্দর কয়েকজনকে বেছে নিতেন।

অষ্টম শ্রেণির তিন ছাত্রীর অভিভাবকের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ। তাদের মধ্যে দুই অভিভাবকের সঙ্গে কথা হয় কালবেলা প্রতিবেদকের। এর মধ্যে সালমা হক গত সোমবার বাদী হয়ে লালবাগ থানায় মামলাও করেন। ঘটনার বিবরণে তিনি জানান, মুরাদ হোসেনের সেন্টারের বড় কক্ষে আমার মেয়ে কোচিং করত। ক্লাসে বেঞ্চের দুটি সারির মাঝখান এতটাই সংকীর্ণ ছিল, মুরাদ হেঁটে গেলেও ছাত্রীদের গায়ে লাগত।

দীর্ঘদিন ধরেই তার মেয়েকে হয়রানি করলেও ভয়ে ও লজ্জায় সে কিছুই জানায়নি। কিছুদিন আগে স্কুলে বিষয়টি জানাজানি হলে শিক্ষকদের মাধ্যমেই প্রথম এ ঘটনা জানতে পারেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে মুরাদ হোসেনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দেন।

অভিভাবক সাহেদা আক্তার কালবেলাকে বলেন, এর আগে কেউ এমন অভিযোগ দিলে সেগুলো ধামাচাপা দেওয়া হতো। সে কারণে নিপীড়নের শিকার অনেকেই অভিযোগ দিতেন না। আবার অনেকে ভয়ে মুখ খুলতেন না। সম্প্রতি মুরাদ হোসেন অষ্টম শ্রেণির শ্রেণিশিক্ষক হওয়ার পর কয়েক শিক্ষার্থীকে হুমকি-ধমকি দেন, যাতে কোনো কিছু প্রকাশ না করে। এর প্রতিবাদ করে আমার মেয়েসহ কয়েকজন। তারা শাখাপ্রধানকে সবকিছু খুলে বলে। এরপর শাখাপ্রধান আমাকে ডেকে পাঠান। পরে আমার মেয়েসহ অন্যরা সবকিছু জানায়। এরপর লিখিত অভিযোগ দিই।

গতকাল মঙ্গলবার ভিকারুননিসার আজিমপুর শাখার সামনে কথা হয় দুই অভিভাবকের সঙ্গে। তাদের একজনের মেয়ে সপ্তম ও অন্যজনের মেয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে। নিরাপত্তার স্বার্থে তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা কালবেলাকে বলেন, ওই শিক্ষককে (মুরাদ হোসেন) ভদ্র বলেই জানতাম। কিন্তু এখন যা শুনছি, তাতে সন্তানকে নিয়ে আতঙ্ক কাজ করছে। কোন শিক্ষকের কাছে যে তারা নিরাপদ, তা নিয়েও দুশ্চিন্তা হচ্ছে। হয়তো মেয়ের কোচিংই বাদ দিয়ে দেব।

নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক সুজা উদ্দিন আহমেদ হারুন কালবেলাকে বলেন, আগেও অনেকের সঙ্গে এমন হয়েছে। তবে মানসম্মানের ভয় আর লজ্জায় তারা প্রকাশ করেনি। এখন সবাই মুখ খুলছেন। প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও যুক্ত হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করে বলেন, অভিযোগ আসার পর প্রতিষ্ঠানের একটি সিন্ডিকেট ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। তদন্ত কমিটি রোল ও নাম উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের ডেকেছিল। কিন্তু এই শাখার ছাত্রীদের রোল ও নাম তাদের জানার কথা নয়। বিশেষ করে কমিটির সদস্য ফারহানা খানম অভিযুক্ত মুরাদ হোসেনকে বাঁচাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। অভিভাবক হিসেবে যা উদ্বেগের। আমরা ভিকারুননিসায় এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চাই না। সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অভিযুক্তের উপযুক্ত শাস্তি চাই।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার শাখা প্রধান সাবনাজ সোনিয়া কামাল বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি শিক্ষার্থীরা যৌন হয়রানির বিষয়টি আমাকে জানায়। পরদিন অধ্যক্ষকে জানাই। তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে ও লিখিত দেওয়ার কথা জানান। ৪ ফেব্রুয়ারি অভিভাবকদের ডেকে পাঠাই। অভিভাবকদের সামনে মেয়েরা সবকিছু খুলে বলে। এরপর ৭ ফেব্রুয়ারি অভিভাবকরা লিখিত অভিযোগ দেন। সেটি অধ্যক্ষকে পাঠানোর পরদিন তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলোও এ সময় চলেছে। বিষয়টিতে কোনো কালক্ষেপণ হয়নি।

লালবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, থানার এক এসআই তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্ত শিক্ষক পরিচালিত কোচিংয়ে যান। সেখানে গিয়ে ফ্ল্যাটটি বন্ধ পান। এরপর মালিক ও আশপাশের লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত চলমান থাকবে।

তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন:

এদিকে মুরাদ হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কেউ প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট নন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ভিকারুননিসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী। কমিটিতে কারা আছেন, তা জানাননি। এর আগে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় মুরাদ হোসেন সরকারকে গত সোমবার রাতে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একই সঙ্গে বিষয়টি অধিকতর তদন্তের জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার অফিস থেকেও তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

দুদিনের রিমান্ডে মুরাদ:

এদিকে যৌন নির্যাতনের অভিযোগে গ্রেপ্তার মুরাদ হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে তদন্ত কর্মকর্তা লালবাগ থানার এসআই ফাইয়াজ হোসেন সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম জাকী আল ফারাবী দুদিন রিমান্ডের আদেশ দেন। এ সময় আইনজীবী শফিকুল ইসলাম দীপু ও আরও কয়েকজন তার রিমান্ড আবেদন বাতিল করে জামিনের আবেদনের ওপর শুনানি করেন।

শিক্ষকদের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধের নির্দেশ:

এদিকে শিক্ষকরা কোচিং-প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না গতকাল নির্দেশনা দিয়েছে ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ। নির্দেশ না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আপাতত শিক্ষকদের সব ধরনের কোচিং-প্রাইভেট বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেউ অমান্য করলে সরকারি বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

দেশে ফিরলেন আমিরাতে ক্ষমা পাওয়া ১৪ বাংলাদেশি

আজকের নামাজের সময়সূচি

শহীদ আমিনুলের সন্তানদের দায়িত্ব নিল ইত্তেফাকুল উলামা

রোববার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

মিছিলে বিএনপি নেতার গুলির প্রতিবাদে বিক্ষোভ

রৌমারীতে ব্যবসায়ীদের আহ্বায়ক কমিটির শপথ অনুষ্ঠিত

৬৫ ভরি স্বর্ণ ছিনিয়ে নেয়ায় মামুনের বিরুদ্ধে যুবদলের মামলা

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইসলামী আন্দোলনে যোগদান

ক্ষমা পেয়ে আমিরাত থেকে ১২ জন ফিরছেন চট্টগ্রামে

১০

‘ছাত্র জনতার আন্দোলনে হাসিনা সরকার দুই ভাবে পরাজিত’

১১

মহানবীকে (সা.) কটূক্তিকারী সেই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা

১২

শিবচর আঞ্চলিক সড়কে গ্রামবাসীর বৃক্ষরোপণ

১৩

মাদ্রাসাছাত্রকে বলাৎকার চেষ্টার অভিযোগ ধামাচাপা, ৭ দিন পর ফাঁস

১৪

১২ দিনেও মেলেনি রানীনগরে নিখোঁজ নার্গিসের সন্ধান

১৫

দায়িত্বশীলদের নিয়ে সাতক্ষীরায় ছাত্র শিবিরের সমাবেশ

১৬

আযহারী শিক্ষার্থীরা হবে বাংলাদেশ ও মিশরীয় ঐতিহ্যের সেতুবন্ধন : মিশরীয় রাষ্ট্রদূত

১৭

রাজশাহীতে বস্তাভর্তি দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার

১৮

আন্দোলনের ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে ছাত্রলীগ কর্মীকে গণধোলাই

১৯

আশুলিয়ায় গার্মেন্টস শ্রমিক অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে শ্রমিক সমাবেশ

২০
X