১০ বছর আগের ঘটনা। শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতনের পর মৃত ভেবে রাজধানীর পল্লবী এলাকার একটি ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ঘটনাটি নিয়ে তোলপাড় হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের তৎকালীন কমিশনার ওই শিশুটির দায়িত্ব নেন। জড়িত গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান ও তার মা ইসরাত জাহানকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। ওই ঘটনায় দায়ের মামলায় ২০১৭ সালে নওরীন জাহানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা করেন আদালত।
২০১৫ সালে শিশু গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তার হ্যাপিকে নির্যাতনের অভিযোগে জাতীয় দলের ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন রাজীব ও তার স্ত্রী জেসমিন জাহানকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এর এক বছর পর আদালতের রায়ে দুজনই বেকসুর খালাস পান। ওই ঘটনায় আদালতের পর্যবেক্ষণ ছিল, রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে।
গত ১০ বছরে গৃহকর্মী নির্যাতনের ওই দুটি ঘটনা বিচার পর্যন্ত গেলেও সাম্প্রতিক সময়ে আর কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। গৃহকর্মী নির্যাতন ও মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ঘটনায় মামলাও হয় না। মামলা হলেও আপস-মীমাংসায় সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন তদন্ত কর্মকর্তা।
গৃহকর্মী সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, গৃহকর্মী নির্যাতনে যুক্ত গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রভাবশালী। এজন্য দরিদ্র গৃহকর্মীর পরিবারগুলো বিচার পায় না। তা ছাড়া তদন্ত প্রক্রিয়া ও বিচার কার্যক্রমে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঘটনাগুলো হারিয়ে যায়। ঘটনার শিকার গৃহকর্মীর পরিবারের পক্ষ থেকে এগুলো নজরদারি করাও সম্ভব হয় না।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) প্রকাশিত গত ৫ বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ১৮২ গৃহকর্মী কর্মস্থলে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে দৈহিক নির্যাতনের শিকার ৭২ জন। ধর্ষণের শিকার ৩১ জন এবং ওই সময়ের মধ্যে নিহত হয়েছে ৭৬ জন। আসকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়সী গৃহকর্মীরা নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছেন। তবে এসব ঘটনার কোনোটিতেই বিচার পায়নি ভুক্তভোগী পরিবার।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি সকালে মোহাম্মদপুরে শাহজাহান রোডের ৯ তলা বাসা থেকে পড়ে মারা যায় কিশোরী গৃহকর্মী প্রীতি উরাং। সে সময় স্থানীয়রা ওই বাড়ির ফটকে জড়ো হয়ে ‘মেয়েটিকে হত্যা করা হয়েছে’ বলে অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করেন। ওই ঘটনায় থানায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর মামলায় গৃহকর্তা সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয় পুলিশ। আশফাক ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক। প্রীতির মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও তদন্ত চেয়ে আন্দোলন চলছে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, দুই লাখ টাকা দিয়ে মৃত্যুর আপস করতে চাচ্ছে আসামি পক্ষ। এর আগে গত বছরের আগস্টে ওই দম্পতির একই বাসা থেকে আরেক শিশু গৃহকর্মী ‘পড়ে’ আহত হয়। ওই সময়েও অভিযোগ ওঠে ওই দম্পতির বিরুদ্ধে। তবে ঘটনায় দায়ের মামলায় পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়।
গত বছরের এপ্রিলে রাজধানীর শান্তিনগরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলা উদ্দিনের বাসা থেকে ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী জান্নাত আক্তারকে দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। পরে সে মারা যায়। ওই ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হলেও পরে ঘটনা আপস করা হয়। সর্বশেষ গতকাল সোমবার রাজধানীর মগবাজারে ডিবির মিরপুর জোনের সহকারী কমিশনার তরিকুল ইসলামের গৃহকর্মী ‘ছাদ থেকে পড়ে’ মারা যান।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) পরিচালক ও গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব নাজমা ইয়াসমীন কালবেলাকে বলেন, গৃহশ্রমিকরা নির্যাতনের শিকার, এমনকি হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রায় সব ঘটনাই আপস হয়ে যায়। নির্যাতকরা প্রভাবশালী হওয়ায় এমনটা হচ্ছে। তারা নানা কায়দায় আপস করে ফেলছেন। এ ছাড়া তদন্ত কার্যক্রম এবং বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রতাও এর বড় কারণ। গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনায় সাজা হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন ঘটনা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যে কারণে নির্যাতনও থামছে না।
তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পর ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ
নীতি-২০১৫’ নামে সরকার একটা নীতি তৈরি করেছে। কিন্তু সেটিরও বাস্তবায়ন এখন নেই। তা ছাড়া গৃহকর্মীদের শ্রমের বিষয়টিও শ্রম আইনভুক্ত নয়। সরকার ঘোষিত নীতির বাস্তবায়ন, গৃহকর্মীদের শ্রম আইন, ২০০৬-এ অন্তর্ভুক্তি করা এবং আইএলও কনভেনশন ১৮৯-এ বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করলে গৃহশ্রমিক নির্যাতন কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
গৃহশ্রমিকদের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও বিলসসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বলছে, এই গৃহশ্রমিকের সংখ্যা ২০ লাখের বেশি। বিলসের এক সমীক্ষার তথ্যানুযায়ী, ঢাকাসহ সারা দেশে গৃহকর্মীর ৯৫ শতাংশের বেশি নারী ও মেয়েশিশু। নিয়োগকারীর সঙ্গে ৯৯ শতাংশের বেশি গৃহকর্মীর কোনো লিখিত চুক্তিও নেই; ১৩ দশমিক ৬ ভাগ গৃহকর্মী পেটে-ভাতে কাজ করে; ৬৪ শতাংশ গৃহকর্মীর সাপ্তাহিক বা মাসিক ছুটি নেই; ৬৮ শতাংশ গৃহকর্মী শারীরিক ও মানসিক চাপ নিয়ে দায়িত্ব পালন করেন এবং ৬৬ শতাংশ গৃহকর্মী গালাগালের শিকার হন। ১৮ বছরের নিচে ৫০ শতাংশ গৃহকর্মীই কোনো না কোনোভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
গৃহশ্রমিকদের মানোন্নয়নে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, মাত্র ১৪ শতাংশ গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি সম্পর্কে অবগত হলেও নিয়োগকর্তা তা জানেনই না।