মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১
জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৬ এএম
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাদক মামলায় যুবলীগ নেতার আয়নাবাজি

ভয়ংকর প্রতারণা
মাদক মামলায় যুবলীগ নেতার আয়নাবাজি

২০২০ সালের আগস্ট মাসে উত্তরায় একটি বাসায় অভিযান চালায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ ফেনসিডিল, গাঁজাসহ আটক করা হয় আনোয়ার হোসেন নামে একজনকে। তবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন মাদক চক্রের মূল হোতা। মাদক উদ্ধারের এ ঘটনায় দুজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিচারে অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় পলাতক ওই ব্যক্তিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। এ পর্যন্ত ঠিকঠাকই ছিল ঘটনা। এরপর যা ঘটেছে, তা যেন আলোচিত ‘আয়নাবাজি’ সিনেমার কাহিনির বাস্তব রূপ।

সাজাপ্রাপ্ত ওই আসামি মাদক কারবারের মূল হোতা মো. নাজমুল হাসান। ঢাকার উত্তরার ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের এই নেতার বাবার নাম আবুল হাসেম চেয়ারম্যান। কিন্তু এই পরিচয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করে যিনি জেল খেটেছেন, তার প্রকৃত নাম মিরাজুল ইসলাম। টাকার বিনিময়ে রীতিমতো চুক্তি করে নাজমুলের সাজা নিজের ঘাড়ে নিয়েছেন তিনি। যদিও চুক্তিমতো সব টাকা পাননি মিরাজুল। জামিনে বেরিয়ে এসে টাকা চাইতে গেলে উল্টো ৫০ পিস ইয়াবা দিয়ে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়।

মাদক মামলার নথি পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০২০ সালের আগস্টে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অভিযান চালায় রাজধানীর উত্তরায়। প্রাইভেটকারে পাচারের সময় মাদক ব্যবসায়ী আনোয়ারকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানকারী দল উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরের ২৫ নম্বর রোডের ১/২ নম্বর বাসায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ ফেনডিসিল ও গাঁজা উদ্ধার করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পালিয়ে যান আরেক মাদক ব্যবসায়ী নাজমুল হাসান। এই ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করা হয়, যার নম্বর ০৪ (০৮), ২০২০। এই মামলার (মেট্রো দায়রা মামলা নম্বর ৭৪৬১/২০২১) অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দুই আসামিকে সাত বছরের জেল দেন অষ্টম দায়রা জজ আদালত। আনোয়ার শুরু থেকেই জেলে থাকলেও নাজমুলকে খুঁজে পায়নি পুলিশ। যদিও স্থানীয়রা বলছেন, ওই সময় নাজমুল নিজ বাসায় থাকলেও পুলিশ তাকে ধরেনি। প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় এই মাদক কারবারি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান।

এই মামলা নিয়ে কালবেলার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। মাদক মামলায় দণ্ডিত হয়ে কাগজে-কলমে কারাভোগ করলেও প্রকৃতপক্ষে এক দিনের জন্যও জেলখানায় যাননি আসামি নাজমুল। তার পরিচয়ে জেলবাস করেন অন্য আরেকজন। এজন্য গাড়ি-বাড়ি এবং বড় অঙ্কের টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়।

জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট নাজমুল পরিচয় দিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন গাজীপুরের মিরাজুল ইসলাম। জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ফলে নাজমুলের পরিবর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যান মিরাজুল। ১১ দিন জেল খাটার পর ওই বছরের ২০ আগস্ট তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।

জানতে চাইলে মামলাটির বাদী তৎকালীন গুলশান সার্কেল ও বর্তমানে পিরোজপুর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপপরিদর্শক মো. সাজ্জাদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে এখানে আমাদের কিছু করার বা বলার এখতিয়ার নেই। এটা আদারতের বিষয়। মামলার বিচার চলাকালে যদি আসামি কাঠগড়ায় থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা হয়তো কথা বলতে পারি।’

একাধিকবার ফোন করে এবং মেসেজ পাঠিয়েও এ বিষয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুবাস কুমার ঘোষের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে ডেপুটি জেলার সিরাজুল সালেহীন কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা যখন কাউকে অ্যাডমিট করি, তখন কোর্ট থেকে তার সাজার পরোয়ানা দিয়ে পাঠানো হয়। তার নাম-ঠিকানা, পিতার নাম, গ্রাম ইত্যাদি তথ্য যাচাই-বাছাই করা হয়।’

তাহলে একজনের পরিবর্তে কীভাবে অন্যজন কারাগারে গেলেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি স্বেচ্ছায় অন্যজনের নাম, ঠিকানা, পিতার নাম ইত্যাদি পরিচয় দেন, তাহলে কী করার থাকে?’

আদালত সূত্র বলছে, মিরাজুলকে নাজমুল সাজিয়ে হাজির করার সময় আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘আমি ওইদিন আদালতে উপস্থিত ছিলাম না। আমার জুনিয়ররা নাজমুলকে নিয়ে গিয়েছিল। তবে এ ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। আমি এ ধরনের লোক না। আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে দেখেন।’

তাহলে নাজমুলের পরিবর্তে মিরাজুল কীভাবে জেলে গেল—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি আমার জুনিয়রদেরও জিজ্ঞাসা করেছি। তারাও কেউ এ ধরনের কাজ করেনি বলে আমাকে নিশ্চিত করেছে।’

যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান মো. মোখলেসুর রহমান বাদল কালবেলাকে বলেন, ‘এটা একটা সাবজুডিশ ম্যাটার (বিচারাধীন বিষয়)। হাইকোর্টে আছে, হাইকোর্ট দেখবেন। তারাই ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আর কোনো আইনজীবী যদি জড়িত থাকেন, তাহলে আমরা বার কাউন্সিলও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারব।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভলিউমে নাজমুলের নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা ঠিক থাকলেও চেহারায় মিল নেই। জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যমতে নাজমুলের বয়স ৩৪ আর মিরাজুলের বয়স মাত্র ২৩। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সংশ্লিষ্ট ভলিউমের তথ্যে দেখা যায়, নাজমুলের উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি, গায়ের রং কালো, গলার বাঁয়ে তিল, ডান হাতের পৃষ্ঠে কাটা দাগ। এ ছাড়া পেটের বাঁয়ে তিল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। তবে প্রকৃত নাজমুলের শরীরে এর কোনোটাই নেই। এ চিহ্নগুলো সবই মিরাজুলের। ভলিউমে যে ছবি লাগানো আছে, সেটিও মিরাজুলের। তবে সেই ছবির ওপর নাম লেখা রয়েছে নাজমুল। বাস্তবে নাজমুল অনেক ফর্সা এবং উচ্চতাও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিরাজুলের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। বর্তমানে বসবাস করছেন গাজীপুরের সাতাইশ চৌরাস্তায়। ওই এলাকার বাসিন্দাদের কাছে খোঁজাখুঁজির করে এই প্রতিবেদক মিরাজুলের কাছে পৌঁছতে সক্ষম হন। শুরুতে কথা বলতে না চাইলেও একপর্যায়ে সব অকপটে জানান তিনি। মিরাজুল বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। একদিন ফরিদ নামে পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে কয়েকটা দিন জেল খাটার অফার করেন। বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ টাকা এবং বাড়ি ও একটা গাড়ি দেওয়ার কথা বলেন। অভাবের সংসারে এমন অফার পেয়ে আমি রাজি হয়ে যাই। যদিও এটা অপরাধ, তবে আমি লোভ সংবরণ করতে পারিনি।’

তিনি বলেন, ‘আমাকে জেলে যাওয়ার সময়ে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এরপর যখন জামিন নিয়ে বের হই তখন আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর পরই যোগাযোগ বন্ধ করে দেন ফরিদ। বারবার তাকে বাকি টাকা এবং বাড়ির কথা বললেও তিনি এড়িয়ে যেতে থাকেন।’

মিরাজ জানান, ‘সর্বশেষ গত ৩ নভেম্বর ফরিদ টাকা দেওয়ার কথা বলে গাজীপুর থেকে উত্তরায় ডেকে আনেন। এরপর ৫০ পিস ইয়াবা দিয়ে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। ফলে আরও ৩০ দিন জেল খাটতে হয়।’

এ সময় নাজমুলের ছবি দেখানো হলে তাকে শনাক্ত করেন মিরাজুল। নিশ্চিত করেন এই নাজমুলই তাকে জেল খাটিয়েছেন। একইভাবে নাজমুলের সহযোগী ফরিদকেও ছবি দেখে শনাক্ত করেন মিরাজুল।

এদিকে কয়েক দিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করেও ফরিদের খোঁজ মেলেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তিনি তুরাগ এলাকার ধরঙ্গারটেক এলাকায় থাকেন। ওই এলাকার বাসিন্দারা ফরিদকে শনাক্ত করতে পারলেও তার বাসার ঠিকানা কেউ দিতে পারেনি।

কে এই নাজমুল:

জানা গেছে, উত্তরার আবুল হাসেম চেয়ারম্যানের ছেলে নাজমুল হাসান ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি এবার ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি প্রার্থী।

মাদক কারবার ছাড়াও এই নাজমুলের বিরুদ্ধে উত্তরা এলাকায় জমি দখল, রাজউকের প্লট দখল, জাল-জালিয়াতি, অস্ত্রবাজি ও কিশোর গ্যাং পরিচালনাসহ নানা অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। উত্তরা পুলিশের পিসিআরে নাজমুলের বিরুদ্ধে তুরাগ থানায় দুটি, উত্তরা পশ্চিম থানায় দুটি এবং ধানমন্ডি থানায় একটি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য গত এক সপ্তাহে তিনবার অভিযুক্ত নাজমুল হাসানের উত্তরার বাড়িতে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করা হলেও ধরেননি। পরে বক্তব্য চেয়ে মেসেজ পাঠানো হলে তিনি উত্তর দেননি।

এরপর নানাবাবে চেষ্টার পর নাজমুলের বড় ভাই ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সদস্য মহিবুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে আমরা আলাদা থাকি। তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই, বলতেও পারব না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কালবেলায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রতিবন্ধী রনি পেল হুইলচেয়ার

শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে : আবু হানিফ

ক্রীড়াবিদ শওকত আলীর স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল

শাহরিয়ার কবির গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন গ্রেপ্তার

রাসূল (স.) আদর্শ ধারণ করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে

ঝিনাইদহে নাশকতা মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার

সাবেক রেলমন্ত্রী সুজনের গ্রেপ্তারের খবরে বিএনপির আনন্দ মিছিল

মানিকগঞ্জে ধলেশ্বরী নদী থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার

ভূমি উপদেষ্টার পরিদর্শন, হয়রানি ছাড়া নামজারি খতিয়ান পেয়ে উৎফুল্ল নাজিম  

১০

চট্টগ্রামে জশনে জুলুশে মানুষের ঢল  

১১

বন্যা পরবর্তী প্রাণী চিকিৎসায় বাকৃবি শিক্ষার্থীরা

১২

‘দুনিয়া ও আখিরাতে মুক্তির জন্য রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ করতে হবে’

১৩

নার্সের ভুলে ৩ দিনের শিশুর মৃত্যুর অভিযোগ

১৪

‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় গণসমাবেশ’ করার প্রস্তুতি বিএনপির

১৫

পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালিত

১৬

রাত ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের আভাস

১৭

সিরাজগঞ্জে কবরস্থানে মিলল অস্ত্র ও গুলি

১৮

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমিরের মতবিনিময়

১৯

২৮ থেকে ৪২তম বিসিএসের বঞ্চিত সেই ক্যাডাররা ফের বঞ্চনার শিকার

২০
X