মানব পাচার আইনে হওয়া মামলাগুলোতে আসামিদের অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। আসামিদের বিচারও শুরু হয়। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও অভিযোগ প্রমাণে জোটে না সাক্ষ্য। এতে আটকে যায় মামলার বিচার কার্যক্রম। পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না মেলায় আর রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতায় অনায়াসে খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মানব পাচার আইনের মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তির নির্দেশনা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় না। ফলে দেখা যায়,Ñ ভুক্তভোগীর সঙ্গে আসামির সমঝোতা, মামলার বিচারে দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষীর অভাব, বিচারে অনাগ্রহ ও রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতায় মানব পাচার আইনের মামলায় আসামিরা খালাস ও অব্যাহতি পেয়ে যায়।
ঢাকায় মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচার কার্যক্রমের পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেছে, গঠনের পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ২৫৫টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ঢাকার মানব পাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে সাজা হয়েছে মাত্র ৪৫টি মামলার আসামিদের। অর্থাৎ, মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। এই হিসাবে ৯৬ শতাংশ মামলায় আসামিরা খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছে।
দেখা গেছে, ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তি হওয়া কোনো মামলায় সাজা হয়নি। সব আসামি খালাস পেয়েছে। ২০২১ সালে ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। ২০২২ সালে ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। ২০২৩ সালের ২২৯টি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে।
জাল কাগজপত্র ও ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে রোহিঙ্গা তরুণীদের মালয়েশিয়া পাঠানোর অভিযোগে ২০১০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিল থানায় মামলা করে ডিবি পুলিশ। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ১৫ জানুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। ২০১২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আদালত আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। সাক্ষীদের আদালতে উপস্থাপনের জন্য বারবার সব প্রক্রিয়া জারি করলেও রাষ্ট্রপক্ষ তাদের হাজির করতে ব্যর্থ হয়। এভাবে ১৩ বছরের বেশি সময় পার হওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল আসামিদের খালাস দেন।
২০১৮ সালের ১৫ আগস্ট মানব পাচার চক্রের খপ্পরে পড়ে ব্রাজিলের উদ্দেশে দুবাই রওনা দেন আব্দুর রহমান রিয়াদ। কাগজপত্র সঠিক না থাকায় দুবাই বিমানবন্দরে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরদিন ১৬ আগস্ট তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দেশে ফিরলে তার পাসপোর্ট রেখে দেয় চক্রটি। অফিসে গেলে তারা আরও ৯ লাখ টাকা দাবি করে। পরে ২০১৯ সালের ২০ মার্চ রাজধানীর রমনা মডেল থানায় তিনজনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। তদন্ত শেষে একই বছরের ২৭ আগস্ট আদালতে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। সব প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ২ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হন। ফৌজদারি মামলা বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকার কোনো আইনগত বা যুক্তিগত কোনো বিধান নেই উল্লেখ করে আসামিদের খালাস দেন আদালত।
মানব পাচারের অভিযোগে ২০২১ সালের ৩১ জানুয়ারি ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে গুলশান থানায় মামলা করে পুলিশ। তদন্ত শেষে একই বছরের ২৬ মে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। ২০২২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। বিচার শুরু হলেও রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষী উপস্থাপন করতে পারেনি। বিলম্ব ন্যায়বিচারের পরিপন্থি উল্লেখ করে বিচারক আসামিদের খালাস দেন।
এসব বিষয়ে ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কে এম সাজ্জাদুল হক শিহাব কালবেলাকে বলেন, সাক্ষী না এলে, তদন্তে ত্রুটি থাকলে এবং আপস-সমঝোতাসহ বিভিন্ন কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা বলা যাবে না। রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণে সর্বাত্মক চেষ্টা করে। সাক্ষীরা যদি আদালতে এসে সঠিক সাক্ষ্য না দেন, তাহলে তো রাষ্ট্রপক্ষের কিছু করার নেই। সাক্ষীরা আদালতে না এলে তো রাষ্ট্রপক্ষ ব্যর্থ হবেই। তবে এই আইন প্রয়োগের কারণে মানব পাচার কমেছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, মানব পাচার মামলার সাক্ষী আসেন না। মামলা তোলার জন্য আসামিরা চাপ প্রয়োগ করে। দীর্ঘসূত্রতার কারণে ভুক্তভোগীদের কিনে ফেলে। মানব পাচার মামলার সুন্দর আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। যে কারণে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। জবাবদিহি, সার্বিক তদারকি ও দ্রুত বিচার শেষ করতে পারলে আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব।