সারা দেশে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা। এ বছর এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৯৫৪ জন। মারা গেছেন ৭৩ জন। এটি হলো সরকারি হিসাব। বাস্তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। শহর-গ্রাম সবখানেই এখন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আগের মাসগুলোর তুলনায় চলতি জুলাই মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৮৩৬ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৫১৬ ও অন্যান্য জেলায় ৩২০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে ভর্তি হন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শুধু তাদের হিসাব পেয়ে থাকে। এ রোগে আক্রান্ত ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। তারা
চিকিৎকের পরামর্শ নিয়ে বাসায় অবস্থান করেন। যারা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসেন না কিংবা বাড়িতে থেকেই চিকিৎসা নেন, তাদের তথ্য সরকারের কাছে থাকে না। ফলে ডেঙ্গু রোগীর প্রকৃত হিসাব পাওয়া কঠিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর ডেঙ্গু জ্বর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার ছাড়া বাকি ৫৯ জেলায় ডেঙ্গুর সংক্রমণ ঘটেছে। শহর ও গ্রামের হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। আক্রান্তদের অনেকে ছুটছেন হাসপাতালে। আবার কেউ ছুটছেন চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত যারা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, তাদের তথ্য সংগ্রহ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন ও কন্ট্রোল রুম। সংস্থাটি ঢাকা শহরের ২০টি সরকারি, ৩৩টি বেসরকারি হাসপাতালসহ মোট ৫৩টি হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এর বাইরে সারা দেশের বিভাগ ও জেলা সিভিল সার্জন অফিস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম জানান, শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৮৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এটি চলতি বছর এক দিনে হাসপাতালে রোগী ভর্তির সর্বোচ্চ সংখ্যা।
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ছয়জন মারা গেছেন। এ নিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৩ জনে। দেশের হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে ২ হাজার ৭৫০ ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে ঢাকার ৫৩টি হাসপাতালে ১ হাজার ৯৬৮ এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে ৭৮২ জন ভর্তি আছেন।
চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল রোববার সকাল পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৯ হাজার ৯০। ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩ হাজার ৮৬৪ জন। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া ৭০ দশমিক ১৭ শতাংশ ঢাকার এবং ২৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ ঢাকার বাইরের। এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন ১০ হাজার ১৩১ জন। আইইডিসিআরের এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর দমন কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এটি সারা বছর ধরে করা দরকার। যখন সংক্রমণ বাড়ে, তখন দমন কার্যক্রম চালালে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমাতে হলে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনসচেতনতা আরও বাড়াতে হবে। যার যার বাড়ি, তাকেই পরিষ্কার রাখতে হবে।
মাসভিত্তিক হাসপাতালে ভর্তির চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এডিস মশা ডেঙ্গু জ্বর ছড়ানোর জন্য দায়ী। এপ্রিল থেকে অক্টোবর এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। তবে এ বছর জানুয়ারি থেকেই ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হয়। জুন মাস থেকে বাড়তে থাকে সংক্রমণ হার। আর চলতি জুলাই মাসে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
হাসপাতালের ভর্তির মাসভিত্তিক চিত্র বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬, মার্চে ১১১, এপ্রিলে ১৪৩, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হন।
পরিসংখ্যান বলছে, জুনে প্রতিদিন গড়ে ১৯৮ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর জুলাইয়ে দৈনিক হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা ৬২২। সামনের দিনগুলোতে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে
এপ্রিল থেকে অক্টোবর ডেঙ্গু সংক্রমণের সময়কাল হলেও জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই তিন মাস সবচেয়ে বিপজ্জনক। আগামী আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ কালবেলাকে বলেন, ‘আগামী দুই মাস ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ আরও বাড়তে পারে। এই সময় থেমে থেমে বৃষ্টির কারণে বিভিন্ন জায়গায় পানি জমে থাকে। এতে এডিস মশার প্রজনন বেড়ে যায়। তাই ডেঙ্গুর সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে।’
তিনি বলেন, ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে এডিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে, সেজন্য বাড়ি বা বাড়ির আশপাশে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে, সে ব্যাপারে সচেতন ও সতর্কদৃষ্টি রাখতে হবে।
ডা. আবদুল্লাহ আরও বলেন, ‘ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের প্রায় ৬০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির দরকার হয় না। তবে অনেক রোগী আছেন যারা ডেঙ্গুর লক্ষণ বুঝতে পারেন না, যখন বোঝেন তখন দেরি হয়ে যায়। এসব রোগী শক সিনড্রোমে চলে যায়। এ ধরনের রোগীকে সামাল দেওয়া চিকিৎসকদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার যারা ডেঙ্গুতে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের জটিলতাও বেশি হয়, তাদের মৃত্যুঝুঁকিও বেশি। এ ছাড়া যাদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগ ও লিভারজনিত রোগ রয়েছে, তাদেরও ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি বেশি। এ ধরনের রোগীদের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারও জ্বর হলেই এনএস-১ পরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে কি না, নিশ্চিত হতে হবে।’
আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ার আভাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও। গতকাল রোববার মানিকগঞ্জের বাসায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে; আগামী আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে সেটি আরও বাড়তে পারে। এ জন্য সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, মশা বেশি থাকার কারণে এ বছর ডেঙ্গু বেড়েছে। বৃষ্টি এবং বিভিন্ন জায়গায় পানি আটকে থাকায় মশা বেশি জন্ম নিচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের একমাত্র পথ হচ্ছে মশা কমানো। মশা কম হলে মানুষ আক্রান্ত কম হবে।
ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে বেড়েছে মৃত্যুঝুঁকি
অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেছেন, চলতি বছর যারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে নরমাল যেসব লক্ষণ সেগুলো এখন পাওয়া যাচ্ছে না। মূলত ডেঙ্গুর ধরন পাল্টে গেছে। আগে প্রচণ্ড জ্বর উঠত, এখন দেখা গেছে জ্বর বেশি ওঠে না। আগে প্রচণ্ড শরীর ব্যথা হলেও এখন ব্যথা বেশি হয় না। ডেঙ্গু হলে আগে র্যাশ উঠত, এখন র্যাশ পাওয়া যাচ্ছে না। আগে জ্বর হওয়ার চার থেকে পাঁচ দিন পর প্লাটিলেট কমত ও রক্তরক্ষণের ঝুঁকি ছিল। এখন দেখা যায়, জ্বর হওয়ার দু-তিন দিন পরই প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে। প্লাটিলেট কমে গেলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। আর রক্তরক্ষণ থেকে শক সিনড্রোমে চলে গিয়ে রোগীর মৃত্যু হয়।
তিনি আরও বলেন, আগে জ্বর হলে রোগীরা ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো বুঝতে পারত। এখন তেমন কোনো লক্ষণ না থাকায় রোগীরা বুঝতে পারেন না। ফলে আক্রান্তরা মনে করেন, সামান্য জ্বর বা ভাইরাস জ্বর হয়েছে। অনেকে এসব ভেবে চিকিৎসকের কাছে যান না বা দেরি করে যান। আবার অনেক চিকিৎসকও সামান্য জ্বর মনে করে বিষয়টিকে গুরুত্ব নাও দিয়ে থাকতে পারেন। এ কারণে রোগীরা বুঝে ওঠার আগেই প্লাটিলেট কমে ব্লিডিং শুরু হয়ে রোগীরা শক সিনড্রোমে মারা যাচ্ছেন।
হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মনিরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত সবার লক্ষণ এক রকম নয়। কারও জ্বর ও পেটে ব্যথা হচ্ছে। কারও মাথা ব্যথা ও জ্বর, কারও বমি ও জ্বর। এসব লক্ষণ দেখা দেওয়ার পর দ্রুত শিশুদের এনএস-১ এবং অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে ডেঙ্গু হয়েছে কি না— নিশ্চিত হতে হবে। কারণ, একটু দেরি হলেই শিশুদের জটিলতা বেড়ে যায়।
আতঙ্কে সাধারণ মানুষ
ডেঙ্গু নিয়ে রাজধানীজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে যাদের বাসায় শিশু আছে তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেশি। মশা মারতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়ার পরও নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন না তারা।
বড় মগবাজারের মিনারা সিদ্দিকী বলেন, ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় বাচ্চাকে খেলাধুলা করতে বাসার নিচে যেতে দিচ্ছি না। আশপাশের বাসার কেউ কেউ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত। বাচ্চাদের নিয়ে খুব টেনশনে আছি। বাসায় অ্যারোসল স্প্রে করে সারা দিন দরজা-জানালা বন্ধ রেখে মশা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছি। বাসায় নিয়মিত অ্যারোসল স্প্রে ও মশারি ব্যবহার করছি।’
মিরপুরের ফখরুল ইসলাম বলেন, চারতলায় বাস করেও মশার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাচ্ছি না। ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে দিন কাটছে।
মন্তব্য করুন