বিএনপি বর্জন করলেও কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে দলটির প্রায় অর্ধশত নেতা গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। এর মধ্যে দলের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের নেতাসহ সাবেক সংসদ সদস্যরাও ছিলেন। এ ছাড়া নির্বাচন ঘিরে নিবন্ধন পাওয়া বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) এবং তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করেও বিএনপির কিছু নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য ভোট করেন। বাকিরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু বিএনপি ভোট বর্জন করায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন জোর গুঞ্জন ছিল, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলটির আলোচিত নেতারা বিশেষ করে সাবেক সংসদ সদস্যদের বিজয়ী করানো হবে। এর পেছনে যুক্তি ছিল, বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও এর মধ্য দিয়ে দ্বাদশ সংসদে দলটির উপস্থিতির বিষয়টি দেখানো হবে। তবে ভোটের ফলে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীদের মধ্যে শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা এসএকে একরামুজ্জামান জয়ী হন।
এদিকে, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে ভোটে যাওয়ায় নেতাদের ‘বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে চিহ্নিত করে সঙ্গে সঙ্গেই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করে বিএনপি। সামনে তাদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার ন্যূনতম কোনো আগ্রহ নেই বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে। যদিও নির্বাচন ঘিরে বহিষ্কৃতরা দলে ফিরতে চান, এমন কোনো কথা তারা এখনো বলেননি। তবে ভবিষ্যতে ভুল স্বীকার করে দলে ফিরতে আবেদন করলেও তাদের জন্য বিএনপির দরজা সহসাই খুলবে না। দলটির নেতারা বলছেন, তারা জেনে-শুনে-বুঝে বিএনপির সঙ্গে ‘বেইমানি’ করেছেন। এর ফলও তারা পেয়েছেন। এমপিত্বসহ নানা প্রলোভনে ভোটে নিলেও শেষ পর্যন্ত তাদের ‘বৃদ্ধাঙ্গুলি’ দেখিয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে দুই কূলই হারালেন বিএনপির এসব সাবেক নেতা।
নির্বাচন বয়কটের পাশাপাশি দলটির নেতাকর্মীদের নির্বাচনে সম্পৃক্ত না হতেও কঠোর নির্দেশনা ছিল বিএনপির। তারপরও মামলা-হামলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া, এলাকায় থাকতে পারার নিশ্চয়তাসহ নানা কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে দলটির অনেক নেতাকর্মী নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হন। এমন অভিযোগে বিএনপির শতাধিক নেতাকেও বহিষ্কার করা হয়। তারাও সহজে দলে ফিরতে পারছেন না। তবে ভবিষ্যতে বিএনপিতে ফিরতে উদ্ভূত পরিস্থিতি তুলে ধরে ভুল স্বীকার করে আবেদন করলে তাদের ব্যাপারে নমনীয় হলেও হতে পারে দলের হাইকমান্ড। কিন্তু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিএনপির সাবেক নেতাদের ব্যাপারে দল অত্যন্ত কঠোর বলে জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘যারা দলছুট হয়ে নির্বাচনে গেছেন, তারা দল এবং নেতাকর্মীদের কাছে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। নেতাকর্মীরা যখন জেলে, সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, তখন দল ও নেতাকর্মীদের সঙ্গে বেইমানি এবং সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে গেছেন। কিন্তু সরকার শেষ পর্যন্ত তাদের বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছে। তাদের উপলব্ধি হওয়া উচিত যে, বেইমান-বিশ্বাসঘাতকদের পরিণতি এমনই হয়। দলের সঙ্গে বেইমানি করলে নেতাকর্মীরাও আর কখনো তাদের গ্রহণ করবে না।’
ভবিষ্যতে ভুল স্বীকার করে বিএনপিতে ফেরার আবেদন করলে তখন দলের ভূমিকা কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে রিজভী বলেন, ‘দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে যারা নির্বাচনে গেছেন, তারা সবাই ম্যাচিউরড লোক। তারা জেনে-শুনে-বুঝেই গেছেন। তারা তো ছাত্রদল-যুবদলের মতো তরুণ না যে, তাদের ভুল হতে পারে। তাদের অনেকে বিএনপি সরকারে ছিলেন, দলেরও গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। বিএনপি দ্বারা উপকৃত, তারপরও তারা গেছেন। তবে ভবিষ্যতে যদি দলে ফেরার আবেদন করেন, দল তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে।’
বিএনপির আলোচিত প্রার্থীদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ-২ আসনে দলের দুইবারের এমপি ও পাঁচবারের বহিষ্কৃত নেতা মেজর (অব.) আক্তারুজ্জামান, কুমিল্লা-৫ আসনে বিএনপি থেকে বহিষ্কার হওয়া ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, বগুড়া-২ আসনে জেলা বিএনপির সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক বিউটি বেগম, বগুড়া-৪ আসনে বিএনপি থেকে চারবার নির্বাচিত এমপি ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, বগুড়া-৭ আসনে সদর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি সরকার বাদল, টাঙ্গাইল-৫ আসনে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার আহসান হাবিব, টাঙ্গাইল-৬ আসনে দেলদুয়ার উপজেলা বিএনপির সদস্য খন্দকার ওয়াহিদ মুরাদ, ময়মনসিংহ-৪ আসন থেকে দেলওয়ার হোসেন খান নির্বাচন করেন।
নির্বাচনের আগে তৃণমূল বিএনপিতে যোগদান করেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে বহিষ্কার হওয়া তৈমূর আলম খন্দকার। কাউন্সিলে শমসের মবিন তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন এবং তৈমূর আলম মহাসচিব হন। নির্বাচনে শমসের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ আসনে এবং তৈমূর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ আসন থেকে দলীয় ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকে ভোট করেন। দুজনেরই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। নির্বাচনের আগে বিএনএমে যোগ দেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য ও দলের সাবেক এমপি শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর। তিনি ফরিদপুর-১ আসন থেকে দলীয় ‘নোঙ্গর’ প্রতীকে ভোট করেন।
বগুড়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কেটলি প্রতীকে নির্বাচন করেন জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা মোহাম্মদ শোকরানা। তিনি কালবেলাকে বলেন, আমি চার বছর আগেই বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছি। সুতরাং দল থেকে বহিষ্কার করা না করার বিষয় আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না।
ভবিষ্যতে আবার বিএনপিতে ফেরা কিংবা দলটির রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা থাকছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপিতে আর কখনো ফিরব না, এটা ঠিক না। তবে আগামী দিনে বিএনপির রাজনীতি কেমন হয়, অবশ্যই তা দেখব। অবশ্য শুধু বিএনপি বলে কথা নেই, যে কোনো দলের রাজনীতিতেই সম্পৃক্ত হতে পারি। কিন্তু আপাতত এমন কোনো চিন্তা নেই। আগামী দিনের রাজনীতি কেমন হয়, তা দেখে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করব।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কলার ছড়া প্রতীকে ভোট করে বিজয়ী হন বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা এসএকে একরামুজ্জামান। ওই আসনে একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত ধানের শীষের প্রার্থী ছিলেন তিনি। একরামুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় দল আমাকে বহিষ্কার করেছে। বর্তমান বাস্তবতায় বিএনপিতে আর ফেরার সুযোগ নেই। তা ছাড়া এখন আমি নিজেকে আর বিএনপির লোকও মনে করি না।
এদিকে নির্বাচনের আগে জামিনে কারামুক্ত হয়েই আওয়ামী লীগে যোগ দেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর। এরপরই তাকে বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি নৌকা প্রতীকে ঝালকাঠি-১ আসন থেকে ভোট করে বিজয়ী হন।