শেখ হারুন
প্রকাশ : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০৪:১৮ এএম
আপডেট : ১৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১০:১০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরের জমিতে ভবন গড়ে ফ্ল্যাট ব্যবসা গৃহায়নের

মোহাম্মদপুরের আদাবর
পরের জমিতে ভবন গড়ে ফ্ল্যাট ব্যবসা গৃহায়নের

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আদাবর এলাকায় প্রায় সাত একর জমিতে ১৫টি আবাসিক ভবন নির্মাণ করেছে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক)। গ্রাহকের কাছে এসব ভবনের ৯০০টি ফ্ল্যাট বিক্রিও করা হয়েছে। অথচ ওই জমির মালিকানাই নেই গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের। কোনো রেকর্ডেই সরকারের এই সংস্থার নাম নেই। ফলে ‘এনএইচএ গার্ডেন সিটি’ প্রকল্পে ফ্ল্যাট কিনে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। দলিল হাতে পেলেও নামজারি করতে পারছেন না কেউ। কষ্টের টাকায় ফ্ল্যাট কিনলেও কাগজে-কলমে তাদের মালিকানা পাওয়ার সুযোগ নেই বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৯৭ সালে মোহাম্মদপুরের এফ ব্লকে মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসন সংকট নিরসনে তৎকালীন গৃহসংস্থান অধিদপ্তর (২০০১ সালে কর্তৃপক্ষ করা হয়) সহজ কিস্তিতে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আদাবর থানার সামনে ৬.৩০ একর জমিতে চার ধরনের প্লট বিক্রির জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিলে প্রায় ২৩ হাজার আবেদন জমা পড়ে। শুরু থেকেই প্রকল্পটি ঘিরে চলে নানা অনিয়ম। টাকা পরিশোধের দীর্ঘদিন পরও প্লট বুঝে পাননি গ্রাহকরা। প্রায় একযুগ পর ২০০৯ সালে প্লটের পরিবর্তে ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা জানানো হয় তাদের। সেইসঙ্গে ব্যয় বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়। ২০১৪ সালের মধ্যেই সব ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও কেটে যায় আরও ৯ বছর। সর্বশেষ ২০২৩ সালের জুনে ক্রেতাদের হাতে রেজিস্ট্রেশন দলিল হস্তান্তর করা হয়।

ভুক্তভোগীরা জানান, দলিল পাওয়ার পর নামজারি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েন ফ্ল্যাট ক্রেতারা। গৃহায়নের দেওয়া দলিল নিয়ে ভূমি অফিসে গেলে সেখান থেকে জানানো হয়, এই জমির মালিকানায় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নাম নেই। গৃহায়নের দেওয়া দলিল সঠিক না হওয়ায় এর মাধ্যমে নামজারি করা সম্ভব নয়। এমনকি ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের নামে ভুয়া দলিল দেওয়া হয়েছে বলেও তাদের অভিযোগ।

একাধিক ফ্ল্যাট ক্রেতা কালবেলাকে বলেন, জমির মালিক না হয়েও ফ্ল্যাট নিবন্ধনের দলিল হস্তান্তর করে গৃহায়ন গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। দলিলের জন্য যেসব তথ্য দিতে হয়, তা না দিয়ে ভুয়া দলিল দিয়েছে।

অনেকের আক্ষেপ, ‘চাকরি জীবনের সঞ্চয় থেকে এত টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছি, কিন্তু মালিক হতে পারছি না।’

ভুক্তভোগীরা জানান, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ফ্ল্যাট কিনেও এমন ভোগান্তিতে পড়তে হবে—এমনটা তারা কল্পনাও করতে পারেননি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেও লাভ হচ্ছে না। তারা এটাকে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। গৃহায়ন বলছে, সরকারি জায়গা কাগজে না থাকলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু নিজের নামে নামজারি করতে না পারলে মালিক হয়েও ভবিষ্যতে ওই ফ্ল্যাট বিক্রি কিংবা স্ত্রী-সন্তানের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না।

এনএইচএ গার্ডেন সিটির ফ্ল্যাট মালিক সমিতির আহ্বায়ক আহসানউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘যারা ফুল পেমেন্ট করেছে তারা দলিল পেলেও জমির মালিকানায় গৃহায়ন না থাকায় নামজারি করতে পারছে না। সমস্যা সমাধানের জন্য ভুক্তভোগীরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা করছে।’

গ্রাহকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করলেও আদতে ওই জমির মালিক গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ নয়। ধানমন্ডি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ যে জমিতে ভবন নির্মাণ করে ফ্ল্যাট বিক্রি করে গ্রাহকদের দলিল দিয়েছে, সেই জমির মালিকানা গৃহায়নের নামে রেকর্ড নেই। আর ভূমি অফিস সূত্র বলছে, ওই জমির মালিকানায় ২০ ব্যক্তির নাম রয়েছে। সর্বশেষ মহানগর জরিপেও এই জমির মালিকানা রয়েছে ২০ ব্যক্তির নামে।

ধানমন্ডি রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার মো. জুলহাস হোসেন সৌরভ কালবেলাকে বলেন, ‘ওই জায়গা গৃহায়নের নামে রেকর্ড নেই। সুতরাং যে জমির মালিকানা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষেরই না, তাদের কাছ থেকে কেনা দলিলের বিপরীতে তো নামজারি করা সম্ভব নয়। এমনকি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকেও এখন পর্যন্ত তাদের নামে জমির রেকর্ড করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘নামজারির জন্য যারা গৃহায়নের দলিল নিয়ে এসেছিলেন, সেটা সঠিক ছিল না। তাই তাদের গৃহায়নের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।’

জমির মালিকানার বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসকের ভূমি অধিগ্রহণের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জমিটি ১৯৭১ সালে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের (তৎকালীন গৃহসংস্থান অধিদপ্তর) নামে হুকুমদখল করা হয় এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবরে গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গেজেট প্রকাশ হলেও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ জমি নিজের নামে রেকর্ড করায়নি।

এদিকে জমির মালিকানা যে গৃহায়নের নামে নেই, তাদের একটি চিঠিতেও তার প্রমাণ মিলেছে। গ্রাহকদের আবেদনের ভিত্তিতে গত অক্টোবরে সহকারী কমিশনার বরাবর চিঠি দিয়ে রেকর্ড সংশোধনের বিষয়ে অনুরোধ করেছেন গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ঢাকা ডিভিশন-২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মিজানুর রহমান। চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘উল্লেখিত জমিটি ভুলবশত জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ড না হয়ে ১৪৮নং খতিয়ানের মাধ্যমে আব্দুল খালেক, পিতা-আলিম মাদবর গংয়ের নামে ও ৭৪৮নং খতিয়ানের মাধ্যমে মো. ইব্রাহিম, পিতা-আব্দুর রহমানের নামে রেকর্ড হয়েছে, যা সরকারি স্বার্থে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নামে সংশোধন করা প্রয়োজন।’

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আলোচ্য জমিতে সরকার তথা জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক চারপাশে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করে ১৬ তলাবিশিষ্ট ১৫টি ভবনে ৯০০টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করে গ্রাহকদের কাছে দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে বরাদ্দ বুঝে পাওয়া গ্রাহকদের নিজ নামে নামজারি করার জন্য রেকর্ড সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় জমির রেকর্ড সংশোধন করে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের নামে রেকর্ডভুক্ত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।’

চিঠির বিষয়ে রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশনার মো. জুলহাস হোসেন বলেন, ‘এমন একটি চিঠি পেয়েছি। কিন্তু রেকর্ড সংশোধনের জন্য নির্বাহী প্রকৌশলী সরাসরি চিঠি দিতে পারেন না। এটা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয় বরাবর দিতে হবে। তারপর যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের যে দলিল দেওয়া হয়েছে তাতেও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। কারণ দলিলের তপশিলে যেসব তথ্য প্রয়োজন হয়, সেগুলো এই দলিলে উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অনেকেই এটিকে ভুয়া দলিলও বলছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি বিধি অনুযায়ী কোনো স্থাবর সম্পত্তির বিক্রয় দলিল নিবন্ধনের জন্য রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০-এর অধীন অবশ্যই বিক্রেতার নামে সেই জমির সর্বশেষ খতিয়ান থাকতে হবে। একই সঙ্গে সম্পত্তির প্রকৃতি, সম্পত্তির মূল্য, সীমানা ও চৌহদ্দিসহ সম্পত্তির একটি নকশা এবং সম্পত্তির গত ২৫ বছরের মালিকানার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থাকতে হবে। বিক্রয় দলিলে যদি এসব বিষয় উল্লেখ করা না হয় তাহলে নিবন্ধন করা যাবে না।

কিন্তু গৃহায়নের দেওয়া দলিলের তপশিলে সিএস দাগ নম্বর এবং সিএস জেএল নম্বর, বিল্ডিং এবং ফ্ল্যাট নম্বর এবং জমির পরিমাণ ছাড়া তেমন কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। মালিকানার বর্ণনা কিংবা কোনো হলফনামাও নেই। তা সত্ত্বেও জমিটির নিবন্ধন দিয়েছেন নিবন্ধনকারী কর্মকর্তা মো. শাহীন আলম। বিধি অনুযায়ী যাচাই-বাছাই না করে তিনি দায়িত্বে অবহেলা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে জানতে শাহীন আলমের ফোনে যোগাযোগে করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এরপর মেসেজ পাঠানো হলেও তার কাছ থেকে সাড়া মেলেনি।

তবে মোহাম্মদপুর সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের একজন সাবেক নিবন্ধনকারী বলেন, ‘দলিলে সঠিক তথ্য না থাকলে সেটা নিবন্ধন করা ঠিক হয়নি। গৃহায়নের পাশাপাশি নিবন্ধনকারী কর্মকর্তাকেও এর দায়ভার নিতে হবে।’

এদিকে গৃহায়নের এমন কর্মকাণ্ডে গ্রাহকদের হয়রানির পাশাপাশি সরকারও প্রাপ্য খাজনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জানা গেছে, ৬ দশমিক ৩০ একর জায়গার বছরে খাজনা হয় ৩৭ হাজার ৮০০ টাকা। যার নামে জমির মালিকানা থাকে, তাকেই খাজনা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু রেকর্ড জটিলতার কারণে ওই জমির কোনো খাজনা পাচ্ছে না সরকার। রাজস্ব সার্কেলের সহকারী কমিশন জুলহাস হোসেন বলেন, ‘জমির খতিয়ান রেকর্ড নিয়ে জটিলতা থাকায় খাজনা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে সরকারের রাজস্ব আদায়ের জন্য জমির মালিকানার বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে।’

জমির মালিকানা না থাকায় হোল্ডিং নম্বরও পাইনি এনএইচএ গার্ডেন সিটি ফ্ল্যাট মালিকরা। এ কারণে ৯০০ ফ্লাটের বিপুল পরিমাণ হোল্ডিং ট্যাক্স পাচ্ছে না সিটি করপোরেশন। এ কারণে সিটি করপোরেশনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খোন্দকার মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমারও জেনেছি। যদিও এটা জটিল কোনো বিষয় নয়। কারণ জমিটি অধিগ্রহণ করা হয়েছে, কিন্তু কোনো কারণে হয়তো গৃহায়নের নামে নামজারি হয়নি। তবে রেকর্ড সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হয়ে গেলেই আর সমস্যা থাকবে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইরেশ যাকের জুলাই আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন : সংস্কৃতি উপদেষ্টা

কাশ্মীর উত্তেজনায় টার্গেটে ইউটিউব চ্যানেল, ১৬টি বন্ধ ঘোষণা

ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারে সরকার বদ্ধপরিকর : আইন উপদেষ্টা

গণমাধ্যম এড়ানোর চেষ্টা / ‘এভাবে যাওয়া যায় না, হাঁটব কীভাবে’ ক্রিকেটার নাসিরকে তামিমা

পুলিশের গাড়িতে ডাকাতির চেষ্টা

সাভারে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় নারীসহ নিহত ৩ 

শোয়েব আখতারসহ ১৬টি পাকিস্তানি ইউটিউব চ্যানেল ভারতে নিষিদ্ধ

ইয়েমেনে মার্কিন হামলায় নিহত ৬৮

৪৬তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা স্থগিত করে প্রজ্ঞাপন

খাল থেকে যুবকের মরদেহ উদ্ধার, শরীরে আঘাতের চিহ্ন

১০

জবিতে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে শিক্ষার্থীকে ছাত্রদলের মারধর

১১

লালমনিরহাটে ট্রেন চালুর দাবিতে সড়ক অবরোধ

১২

প্রকৃতিতে ঝুমকার মতো ঝুলছে সোনালু ফুল 

১৩

প্যারাগ্লাইডারে আকাশে ওড়া মারুফের পাশে ইউএনও

১৪

নাসির-তামিমার মামলায় বিব্রত আদালত, অবশেষে বদলি

১৫

অতীতে শুধু ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি : বুলবুল

১৬

কোথায়, কখন হতে পারে বজ্রবৃষ্টি জানাল আবহাওয়া অফিস

১৭

ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা  / সম্ভাব্য যুদ্ধের স্পর্শ থেকে বাংলাদেশ কি বাঁচবে?

১৮

চাঁদা তুলে অফিস সংস্কার করলেন শিক্ষা কর্মকর্তা 

১৯

চট্টগ্রাম টেস্ট / প্রথম সেশনে বাংলাদেশের প্রাপ্তি ২ উইকেট

২০
X