পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন—জনপ্রশাসন ও পুলিশের এমন কর্মকর্তাদের তালিকা করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষণার পর এ ধরনের আমলাদের চিহ্নিত করতে দুই পক্ষই তৎপর হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে নিষেধাজ্ঞার চাপ সৃষ্টি করতে চায় বিএনপি—আগামী নির্বাচনে যাতে তারা আওয়ামী লীগের প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করতে পারে। অন্যদিকে, ভিসা নীতির কারণে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কর্মকর্তাদের আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে রাখতে চায় না আওয়ামী লীগ।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৫ মে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এতে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী ও তাদের স্বজনদের ভিসা দেওয়া হবে না বলে জানিয়ে দেয় দেশটি। এই ভিসা নীতি ঘোষণার পর জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক কর্মকর্তার মধ্যে দেখা দেয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিশেষ করে যেসব কর্মকর্তার স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা কিংবা ভাইবোন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস কিংবা পড়াশোনা করছেন, সেসব কর্মকর্তার মধ্যে বেশি অস্বস্তি ও দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় তাদের পক্ষে আগামী নির্বাচনে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যেসব কর্মকর্তার পরিবারের সদস্য যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন—পরিস্থিতি বিবেচনায় তাদের তালিকা করছে আওয়ামী লীগ। মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় তারা নির্বাচনে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে না বলে দলটির আশঙ্কা। এই কর্মকর্তাদের নির্বাচনকালে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দায়িত্বে রাখতে চায় না আওয়ামী লীগ।
অন্যদিকে, বিএনপির পক্ষ থেকেও একই ধরনের তালিকা করছেন দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে থাকা সাবেক আমলারা। এরই মধ্যে আন্দোলন ও নির্বাচনে বাধাদানকারী কর্মকর্তাদের তালিকা করেছে দলটি। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীদের পরিবারের সদস্য কর্মকর্তাদের তালিকা করার উদ্যোগ নিয়েছে দলটি। মূলত ভিসা নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সামনে এনে নির্বাচনকালে এই কর্মকর্তাদের চাপে রাখাই উদ্দেশ্য বিএনপির। নির্বাচনের সময় সরকারী প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যাতে একতরফাভাবে আওয়ামী লীগের পক্ষে ভূমিকা পালন না করেন, সে ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এ ধরনের তৎপরতা সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারে এখন যারা আছেন এবং আগে যারা ছিলেন, জানা-অজানা কারণে তারা এ ধরনের তালিকা করে আসছেন—যা মূলত রাজনৈতিক বিবেচনাপ্রসূত। এটি নিয়ে অনেক ক্ষোভ আছে গণকর্মচারীদের। অভিযোগ করা হয়, প্রশাসন দলীয়করণের লক্ষ্যে এসব করা হয়। ভিসা নীতির কারণে তালিকা প্রণয়ন নতুন ধারার সূচনা। শুধু কর্মকর্তাদের তালিকা কেন? অন্যদেরও তালিকা হয়তো করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ অবাধ, সুষ্ঠু, প্রতিযোগিতাপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন আয়োজন। তালিকা না করে এ বিষয়ে সবার মনোযোগ দেওয়া এখন গুরুত্বপূর্ণ। তালিকা করে মূল সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে করি না।’
বিষয়টি নিয়ে সরাসরি কথা বলতে রাজি হননি ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতা। তারা বলছেন, নির্বাচনকালে সরকারি কর্মকর্তাদের কাকে কোথায় দায়িত্ব দেওয়া হবে—তা সম্পূর্ণভাবে সরকারের বিষয়। এখানে দলের কোনো ভূমিকা নেই। তবে নির্বাচনে কেউ দলীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারেন—এমনটা নিশ্চিত হওয়া গেলে বা আশঙ্কা থাকলে নিশ্চয়ই সেই কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করা হবে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আমলা রশিদুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি নানারকম তালিকা করে সরকারি কর্মকর্তাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। এভাবে ভয় দেখিয়ে কোনো কাজ হবে বলে মনে হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের চাপে কী আসে যায়? ভিসা নীতি বা অন্য কিছু দিয়ে এসব কর্মকর্তাকে নির্বাচনে বিতর্কিত ভূমিকা রাখতে প্রভাবিত করা যাবে না। তবে ব্যক্তিগতভাবে কারও যদি আগ্রহ থাকে, সেটা ভিন্ন কথা।’
২০০১ সালের নির্বাচনে আমেরিকার ভূমিকার প্রসঙ্গ টেনে আওয়ামী লীগের এই উপদেষ্টা বলেন, সেই নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। পাকিস্তানিরা অর্থ দিয়ে আমাদের অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে কিনে ফেলেছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে অনেক সচিবকে সময়ের আগেই অবসরে পাঠাতে বাধ্য করেছিল। এরকম পুনরাবৃত্তি হওয়ার সুযোগ নেই।
আর এ ধরনের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগের তথ্য নাকচ করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস। এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি পুলিশ কিংবা সিভিল প্রশাসনের কোনো তালিকা করছে না। বিএনপি কী জন্য, কীসের তালিকা করবে। বিএনপির এমন কোনো তালিকা করার প্রয়োজন নেই।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে আগামীতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। মার্কিনিরা তাদের রাষ্ট্রীয় পলিসি অনুযায়ী এটা করেছে। এখানে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কিংবা দুঃখ পাওয়ার কিছু দেখি না।’
দলটির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘যারা অতীতে সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করেছেন, মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হবেন—এটাই স্বাভাবিক। উদ্বেগের ফলস্বরূপ তারা হয়তো আগামী নির্বাচনে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করবেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন নির্বাচন? কারণ, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশগ্রহণ করবে না। যে নির্বাচন বিরোধী দলগুলোসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য হবে—সেই নির্বাচন হলে তখন এ নিয়ে মন্তব্য করা যথাযথ হবে।’
বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত—এমন যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধীদলীয় সদস্যরাও এই ভিসা নীতির আওতায়। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও ভিসা নীতির অন্তর্ভুক্ত থাকবেন।’
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘যারা মানুষের নাগরিক অধিকারকে দমন করেছে, হরণ করেছে—তাদের হাত থেকে দেশটাকে মুক্ত করতে হবে। আর এই কাজে যে-ই সমর্থন করুক, নিশ্চয়ই সেটা আন্দোলনকারী গণতন্ত্রকামী মানুষকে উৎসাহিত করবে।’
মন্তব্য করুন