দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ। এখন শুধু ভোটের জন্য অপেক্ষা। আগামীকাল রোববার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে। এর ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচার কার্যক্রম শেষ করার নিয়ম মেনেই গতকাল সকাল ৮টায় সারা দেশে সব ধরনের প্রচারের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়েছে। এর পরও নানাভাবে অনানুষ্ঠানিক প্রচার এবং পোলিং এজেন্ট চূড়ান্তকরণে প্রার্থীরা ব্যস্ত রয়েছেন।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল সকাল ৮টায় প্রচারের সময় শেষ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কেউ আইন না মানলে ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। কমিশন চাইলে কারও প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে পারে।
নওগাঁ-২ আসনের এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যু হলে সেখানে ভোট স্থগিত করেছে ইসি। এর ফলে ২৯৯ আসনের ভোটাররা জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পাবেন। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী রয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের। হাইকোর্ট থেকে তিনজন প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ায় দলটির প্রার্থী ২৬৬ জন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ২৬৫ জন, তৃণমূল বিএনপির ১৩৫, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ১২২, বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ৫৬ জনসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ২৭টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী সংখ্যা ১ হাজার ৫৩৪। স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। সব মিলিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ১ হাজার ৯৭০ জন। এর মধ্যে ৯০ জন নারী ও ৭৯ জন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এ ছাড়া নির্বাচনে ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, জাকের পার্টি, জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি-জেপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, তৃণমূল বিএনপি, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কংগ্রেস, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ও বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএল) প্রার্থী দিয়েছে।
নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপিসহ ১৬টি দল এ নির্বাচন বয়কট করেছে। নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছে দলগুলো।
সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক্ষক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও অভিন্ন কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন, দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ক্ষেত্রে এ বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে। সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তঃজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল করা হবে।
এবারের নির্বাচনে ৪২ হাজার ২৫টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্গম ২ হাজার ৯৬৪ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের আগের দিন শনিবার ব্যালট পেপার পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে ইসি। এ ছাড়া ভোটের দিন সকালে ৩৯ হাজার ৬১ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার যাবে। ভোট গ্রহণের দিন সংশ্লিষ্ট সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা বা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছ থেকে ব্যালট পেপার সংগ্রহ করে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সঙ্গে ভোর ৬টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে হস্তান্তর করবেন। ভোট গ্রহণের দিন সকালে ব্যালট পেপার পরিবহনের বিষয়ে মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করবে।
নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় সাড়ে ৭ লাখ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ আনসার সদস্য। বাকিদের মধ্যে রয়েছে বিজিবি, র্যাব, পুলিশ, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনী। এরই মধ্যে গত ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত আট দিন মাঠে থাকবেন তারা। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত লাইসেন্সধারীরাও আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবেন না।
নির্বাচন কেন্দ্র করে আট বিভাগে ২ হাজারেরও বেশি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে গতকাল থেকে মাঠে নেমেছেন আরও ৬৫৩ বিচারিক হাকিম। তারা ভোটের আগে-পরে পাঁচ দিন দায়িত্ব পালন করবেন। এর আগে সারা দেশে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি করা হয়। তারা বিভিন্ন অপরাধে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের রেকর্ডসংখ্যক শোকজ, তলব ও জরিমানা করেন। এসব কমিটির সুপারিশে নিয়মিত আদালতে অর্ধশতাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত হয়।
১৮৬ বিদেশিকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি: নির্বাচন দেখার জন্য যেসব বিদেশি আবেদন জানিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ১৮৬ পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে ১২৭ পর্যবেক্ষক আর ৫৯ জন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মী। এ ছাড়া নির্বাচন দেখতে দেশি ২০ হাজার ৭৭৩ পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০ পর্যবেক্ষণ সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪ সংস্থার ২ হাজার ২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবেন।
২২ সদস্যের মনিটরিং সেল: নির্বাচন উপলক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে কমিশন। এই মনিটরিং সেলের নেতৃত্ব দেবেন আইডিএ প্রকল্প-২-এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী, মনিটরিং সেল শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টা পরিচালনা করা হবে। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ে যথাসম্ভব যাচাই-বাছাই করা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবহিতকরণ এবং জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠাবেন।
ব্যয় ২৩০০ কোটি টাকা: এ নির্বাচনের ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। আসনপ্রতি ৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় করবে ইসি। বিশাল এ বাজেটের বেশিরভাগ অর্থই ভোটের দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পেছনে ব্যয় হবে। জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে প্রাপ্ত চাহিদা অনুযায়ী সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ১ হাজার ২২৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা এবং নির্বাচন পরিচালনা খাতে সম্ভাব্য ব্যয় ১ হাজার ৫০ কোটি ৬০ লাখ টাকা।
এবারের নির্বাচনে ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। এর মধ্যে ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ পুরুষ, ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ নারী এবং ৮৫২ জন হিজড়া।
ঘরে বসেই মিলবে ভোটার নম্বর, কেন্দ্রের তথ্য:
ইসির ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ নামের অ্যাপে ভোটার নম্বর, কেন্দ্রের নাম ও অবস্থান, ভোট পড়ার হার, প্রার্থীদের হলফনামাসহ নির্বাচনের বিভিন্ন তুলনামূলক চিত্র ঘরে বসেই জেনে নিতে পারবেন আগ্রহীরা। দুই ঘণ্টা পরপর আসনভিত্তিক ভোট পড়ার হারও জানানো হবে সেখানে। অ্যান্ড্রয়েড ও অ্যাপল উভয় প্লে স্টোরে অ্যাপটি পাওয়া যাবে। অ্যাপটি ব্যবহার করতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্মতারিখ ও মোবাইল নম্বর দিয়ে নিবন্ধন করতে হয়। পরে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মতারিখ দিলেই মিলবে তথ্য। অ্যাপটি গত ১২ নভেম্বর উদ্বোধন করার পর এ পর্যন্ত এক লাখের বেশি ডাউনলোড করা হয়েছে।