‘সম্মিলিত মহাজোট’ গঠন করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কংগ্রেস। সব মিলিয়ে ১০৯ আসনে প্রার্থী দিয়েছে ৯৩ দলের সমন্বয়ে গঠিত এই জোট। বাংলাদেশ কংগ্রেসের ডাব প্রতীকে নির্বাচন করছেন তারা। তপশিল ঘোষণার আগে প্রার্থীদের আর্থিক ও অন্যান্য সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন জোটের শীর্ষ নেতারা; কিন্তু এখন আর তাদের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি প্রার্থীদের ফোন পর্যন্ত ধরছেন না বড় নেতারা। এ কারণে ভোটের মাঠে নেমে মহাবিপাকে পড়েছেন কংগ্রেসসহ জোটভুক্ত বিভিন্ন দলের প্রার্থীরা।
শুধু বাংলাদেশ কংগ্রেস নয়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া আরও কয়েকটি দলের প্রার্থীদের একই অবস্থা। এদের অনেকের ধারণা ছিল, বিএনপিসহ অনেক দল না আসায় এবারের নির্বাচনে ছোট দলের প্রার্থীদের বেশ কদর থাকবে। নির্বাচনের খরচ বাবদ নানা মাধ্যমে টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে—অনেকের মনেই ছিল এমন আশা। এমন আশ্বাসও দিয়েছিলেন কোনো কোনো দলের নেতারা। বেশিসংখ্যক প্রার্থী দিয়ে আলোচনায় থাকার চেষ্টা করেছিলেন তারা। এসব কারণে নিবন্ধিত দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিতে এগিয়ে আসেন অনিবন্ধিত বিভিন্ন দলের নেতারা। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে আলোচিত বিভিন্ন দলের মনোনয়ন পেতে তৎপর হন।
তবে ভোটের মাঠে নেমেই হোঁচট খেতে শুরু করেন তারা। আর্থিক বা অন্য কোনো সহায়তা তো দূরের কথা, যেই নেতাদের মুখ দেখে দলের মনোনয়ন নিয়েছিলেন, তারা এখন কোনোরকম খোঁজই নিচ্ছেন না। ফলে অনেক প্রার্থীই প্রচার-প্রচারণায় আগ্রহী হচ্ছেন না। অনেকে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
এবারের নির্বাচনে আলোচিত দল তৃণমূল বিএনপির ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে নামা ৬০ প্রার্থী এরই মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে দলের দুই শীর্ষ নেতাকে ‘জাতীয় বেইমান’ আখ্যা দিয়েছেন। আলোচিত আরেক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) শীর্ষ নেতাদের ওপরও অনেক প্রার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।
বিপাকে ‘ডাব’ প্রতীকের ১০৯ প্রার্থী:
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্বে ৯২টি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিয়ে সম্মিলিত মহাজোট গঠিত হয়। জোটের আহ্বায়ক হন বাংলাদেশ কংগ্রেসের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট কাজী রেজাউল হোসেন। জোট গঠনের সময় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ডেকে ৩০০ আসনে প্রার্থিতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে প্রার্থী খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মাত্র ১০৯ আসনে ডাব প্রতীকে প্রার্থী দেয় সম্মিলিত মহাজোট। তাদের মধ্যে ৪৭ জন কংগ্রেসের। বাকিরা অন্যান্য দলের প্রার্থী। ভোটে নামাতে প্রার্থীদের আর্থিক সুবিধাসহ অন্যান্য সহযোগিতা করার আশ্বাস দেওয়া হলেও এখন তাদের কোনো খোঁজই নিচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। এ নিয়ে ডাব প্রতীকের প্রার্থীরা কংগ্রেসের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। সবাই মিলে ভোট বর্জনের চিন্তা করলেও নানা বিবেচনায় সেই পথে যাচ্ছেন না। তবে এসব প্রার্থী ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবেন কি না—তা নিয়ে এখনো তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। কংগ্রেসের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা ও প্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।
কংগ্রেসের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ও কুমিল্লা-১০ আসনে ডাব প্রতীকের প্রার্থী মো. কামরুজ্জামান বাবলু অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের ভোটের মাঠে ঠেলে দিয়ে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এখন কোনো খোঁজ নিচ্ছেন না। ভোটে নেমে ন্যূনতম সহযোগিতা আমরা পাচ্ছি না। ফলে ডাব প্রতীকের প্রার্থীরা সবাই ক্ষুব্ধ। ভোটের মাঠে টিকে থাকা আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে দলের শীর্ষ নেতারা লাপাত্তা হয়ে যাবেন— এমনটা ভাবতেও পারিনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কংগ্রেসের মহাসচিব অ্যাডভোকেট মো. ইয়ারুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘দলের প্রার্থীরা অভিযোগ তুলেছেন, আমরা তাদের কোনো আর্থিক সহযোগিতা করছি না। আমরা আর্থিক সহযোগিতা করব—এমন কোনো কমিটমেন্ট (প্রতিশ্রুতি) দিইনি। ভোটে নেমে আমরা নিজেরাও বিপদে আছি। কারণ আমাদের দলের কোনো ফান্ড (তহবিল) নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীরা সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে আমাদের ভোটে নামিয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো অনুদান পাইনি। ফলে কংগ্রেসের ৪৭ প্রার্থীসহ সম্মিলিত মহাজোটের প্রার্থীদের কাউকেই আমরা আর্থিক সহযোগিতা করতে পারিনি।’
চেয়ারম্যান ও মহাসচিব প্রার্থীদের ফোন পর্যন্ত ধরছেন না—এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাডভোকেট ইয়ারুল জানান, ‘আমি সাতক্ষীরা-১ আসনে নির্বাচন করছি। আমার দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট রেজাউল করিম মাগুরা-১ ও মাগুরা-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দুজনই ভোটের প্রচারে ব্যস্ত। এজন্য অন্যদের প্রার্থীদের ফোন ধরতে পারি না। তা ছাড়া কেউ কেউ দিনে তিন থেকে চারবার ফোন দেন। একজনের ফোন কতবার ধরা যায়! আমাদেরও তো কাজ থাকে। তা ছাড়া চেয়ারম্যান ফোন ধরেন না, কারণ তার মোবাইলে অনেক সময়ই চার্জ থাকে না।’
‘সোনালী আঁশ’ নিয়ে বেকায়দায় তৃণমূলের প্রার্থীরা:
১৩৭ জনকে মনোনয়ন দিয়ে ভোটের মাঠে নামিয়ে তাদের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করছেন না তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার। গত শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এমন অভিযোগ তুলে দুই নেতাকে ‘জাতীয় বেইমান’ আখ্যা দিয়েছেন ‘সোনালী আঁশ’ প্রতীকের ৬০ প্রার্থী। শমসের, তৈমূর ও তৃণমূল বিএনপির নির্বাহী চেয়ারপারসন অন্তরা হুদা দলের তহবিল থেকে টাকা তছরুপ করেছেন বলেও অভিযোগ করেন তারা।
তৃণমূলের বেশ কয়েকজন প্রার্থী বলেন, তাদের ভোটের মাঠে ঠেলে দিয়ে শীর্ষ নেতারা কোনো খবর নিচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
ঢাকা-১৫ আসনে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী খন্দকার এমদাদুল হক ওরফে সেলিম বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন ও মহাসচিব আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখছেন না। আমাদের সুবিধা-অসুবিধা, কীভাবে আমরা নির্বাচন করছি, আমাদের কী প্রয়োজন, সে ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর রাখছেন না।’
এসব কারণে তৃণমূল বিএনপির ১৩৭ প্রার্থীর মধ্যে ১৩০ জনই ক্ষুব্ধ বলে সেলিম জানান।
জানা গেছে, তৃণমূল বিএনপির বেশিরভাগ প্রার্থীই নির্বাচনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পারছেন না। তবে সিলেট-১ আসনে দলটির চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরীকে জেতাতে মাঠে নেমেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
দলটির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকারও নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে জোরেশোরে মাঠে আছেন।
তবে দলীয় প্রার্থীদের এসব অভিযোগ নাকচ করেছেন তৃণমূলের শীর্ষ দুই নেতা। দলের চেয়ারপারসন শমসের মুবিন চৌধুরী বলেন, ‘তারা যখন মনোনয়নপত্র নেন, তখন বড় বড় কথা বলেছিলেন। এখন পারছেন না, তাই নানা কথা বলছেন। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে নেতাদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন।’
মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার বলেন, ‘আমরা প্রার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফান্ড (তহবিল) দিতে পারিনি, এটা সত্য। প্রার্থীরা নির্বাচনী ব্যয় নিজেরা বহন করবেন, সেটা লিখিত দিয়েছিলেন। আমরা দল থেকে কিছু খরচ দিয়েছি। তবে যাদের মাঠে পাওয়া যায়নি, তাদের দেওয়া হয়নি।’
বিএনএম ও সুপ্রিম পার্টির প্রার্থীদেরও হতাশা:
এবারের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায় বিএনএম ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। ভোটের মাঠে এই দল দুটি এবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে—এমন আশা নিয়ে অনেকেই মনোনয়ন নিয়েছিলেন। তবে প্রার্থীদের বেশিরভাগই দল থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হয়েছে। ভোটের মাঠে মর্যাদার সঙ্গে লড়াই করার জন্য যেসব দলীয় সহায়তা দরকার, তার কিছুই পাচ্ছেন না তারা। দলগুলোর নেতা ও তাদের প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটি জানা গেছে।