বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে গত কয়েক মাস পশ্চিমা কূটনীতিকরা নানামুখী তৎপরতা চালিয়েছেন। সবচেয়ে বেশি সরব ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতিও দিয়েছে দেশটি। এসব তৎপরতার জবাবে সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার অঙ্গীকার জানানো হয়েছে। তা সত্ত্বেও বিএনপি ও তাদের মিত্ররা নির্বাচনে আসেনি। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী ইতোমধ্যেই মনোনয়নপত্র জমার সময় পেরিয়ে গেছে। ফলে বিএনপিকে ছাড়াই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই অবস্থায় নির্বাচন ঘিরে কূটনীতিকদের প্রকাশ্য তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সরকার ও নির্বাচন কমিশন সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়ায় আগ্রহী দেশগুলো সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখছেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, বিএনপি অংশ না নিলেও অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ, নির্বাচনী পরিবেশ, আচরণবিধি অনুসরণসহ সার্বিক পরিস্থিতির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছেন পশ্চিমাসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা। নির্বাচন পর্যন্ত তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। নিবন্ধিত ২৯টি দল ছাড়াও বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অংশগ্রহণ এবারের নির্বাচনকে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা, প্রভাব বিস্তার ও কারচুপি হয় কি না—সে বিষয়েও সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন বিদেশি কূটনীতিক ও পর্যবেক্ষকরা। তবে নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে কোনো চাপ প্রয়োগ করবে না বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর ছিল মনোনয়নপত্র জমার শেষ দিন। এর পরই বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে এবারের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কিত তথ্য তুলে ধরা হয়। তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, জাতীয় নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ২ হাজার ৭১১ প্রার্থী। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ৩৩ জন সাবেক সংসদ সদস্যসহ বিএনপির ৭৪৭ জন নেতাও রয়েছেন। নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ধরনের তথ্য তুলে ধরবে বলে জানা গেছে।
আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক তৎপরতা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পশ্চিমা কূটনীতিকরা বিশেষ করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বরাবরই সক্রিয় ছিলেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের অঙ্গীকার সত্ত্বেও ভিসা নীতি ঘোষণাসহ নানা চাপ ও পরামর্শ অব্যাহত রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা, পুলিশ হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সে হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, সাংবাদিকদের ওপর হামলাসহ ব্যাপক সহিংসতা হয়। এসব সহিংসতার মামলায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অনেক নেতাকর্মী কারাবন্দি হলে দলটি নির্বাচন বর্জনে অনড় থাকে। ফলে সংলাপের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরই মধ্যে তপশিল ঘোষণা ও মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়। এখন চলছে যাচাই-বাছাই। পিটার হাসও কলম্বোয় ছুটি কাটিয়ে এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ অব্যাহত রাখলেও ঢাকায় কূটনৈতিক তৎপরতা কমে গেছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো চাপ ও পরামর্শ দিয়ে বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। তবুও নির্বাচন প্রশ্নে সরকার ও বিরোধীদের অনড় অবস্থানের মধ্যেই পরিস্থিতি নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। তাই বিদেশি বন্ধুরা মনে করছেন, আপাতত কথা বলে লাভ নেই। তবে তাদের বাহ্যিক তৎপরতা না থাকলেও তারা বসে থাকবেন না। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে তারা শ্রমিক অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে নানা ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারেন বলে ঈঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এখন বিপুলসংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীর উপস্থিতি দিয়ে নির্বাচন কতটা অংশগ্রহণমূলক করা যাবে, সেটিও দেখার বিষয়।’
সংশ্লিষ্ট কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পাশাপাশি মতপ্রকাশের অধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে ঢাকার পশ্চিমা কূটনীতিকরা একমত। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর অবস্থান নেয়নি ইইউসহ বিভিন্ন দেশ। শুরু থেকে নির্বাচন ইস্যুতে ঢাকায় পিটার হাস কূটনীতিকদের নেতৃত্ব দিলেও ২৮ অক্টোবরের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, ইইউসহ বিভিন্ন দেশ নিজেদের মতো করে নির্বাচনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক এবং ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ইসিসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচন-সংক্রান্ত তথ্য জানছেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই), কমনওয়েলথসহ বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও আগামী নির্বাচন পর্যবেক্ষণে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চার সদস্যের একটি কারিগরি বিশেষজ্ঞ দল দুই মাসের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করছে। গতকাল রোববার ইইউর নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মিশনের সদস্য ডেভিড নোয়েল ওয়ার্ড (নির্বাচন বিশেষজ্ঞ), আলেকজান্ডার ম্যাটাস (নির্বাচন বিশ্লেষক), সুইবেস শার্লট (নির্বাচন বিশ্লেষক) এবং রেবেকা কক্স (আইনবিদ) নির্বাচন কমিশনে গিয়ে নির্বাচনী আইন ও ভোটের প্রস্তুতি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন। তারা আগামী নির্বাচন ঘিরে চলমান রাজনীতি ও ভোট-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
এরই মধ্যে ভারতও প্রতিবেশী দেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দিয়েছে। গত মাসে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত টু প্লাস টু বৈঠকের পর দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টই বলেন, ভারত কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলবে না। দেশটি বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন চায়। সংবিধান অনুযায়ী অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার সরকারের অঙ্গীকারের প্রতি তারা আস্থা রাখে। ওই বৈঠক প্রসঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, দিল্লির পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনকে বার্তা দেওয়া হয়েছে, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখলে আঞ্চলিক সংকট সৃষ্টি হতে পারে। এদিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে চীন এবং রাশিয়াও ভারতের সঙ্গে একমত। প্রায় মস্কো-ওয়াশিংটন বাংলাদেশ নিয়ে বাগবিতণ্ডাও করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের নির্বাচনে ভোটের দিন জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ইসি ও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটার উপস্থিতি অস্বাভাবিক কম হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। অতীত নির্বাচন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, বড় দলগুলো অংশ নিলেই জনগণ ভোট দিতে উৎসাহী হয়। ২০০৮ সালে দুই বড় দলের অংশগ্রহণ থাকায় ৮৭ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছিল।
২০১৪ ও ২০১৮ সালের ঘাটতিগুলো দূর করে আগামী নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের মধ্যে মতভিন্নতা স্পষ্ট হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপে রাখতে ভিসা নীতির মতো ব্যবস্থা নিলেও অন্য কোনো দেশ এখনো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাওয়ায় শুধু বিদেশিদের কাছে নয়, বাংলাদেশের কাছেও ভোটের দিনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সরকার জানে, সারা দুনিয়া এবারের নির্বাচনের ওপর চোখ রেখেছে। তাই নির্বাচনের দিন ভোটকেন্দ্রে বিপুলসংখ্যক ভোটার আনা, অন্যবারের চেয়ে বেশি বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় তাদের প্রভাব বিস্তার প্রতিরোধ এবং নির্বাচন বানচালের অপচেষ্টা প্রতিরোধই সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।’