দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, রাজনীতির মাঠে তত চমক দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক মহলের অনেকেই বলেছিলেন, বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন একতরফা হবে। এই ধারণা দিন দিন ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছে। দেশের ছোট দলগুলোর অধিকাংশই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কোনো দল এককভাবে, কোনো দল জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা এরই মধ্যে জানান দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের আগেই দেশে উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ফলে বিএনপি অংশগ্রহণ না করলেও দেশের প্রতিটি আসনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে মনে করছেন অনেকে।
দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৪টি। এখন পর্যন্ত কম-বেশি ২২ থেকে ২৫টি দল নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শেষ পর্যন্ত নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে ৩০টির মতো দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। আজ-কালের মধ্যে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এদিকে, নির্বাচনে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকার পতনের একদফা দাবিতে আন্দোলনে করলেও সম্প্রতি চিত্র বদলে যাচ্ছে। বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনরত দুটি দল ইতিমধ্যে নির্বাচনে যাওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে। এমনকি বিএনপির সঙ্গ ত্যাগ করে আসা দল দুটির জোট মনোনয়ন ফরমও বিতরণ করছে। এ ছাড়া বড় কোনো দলের সঙ্গে না থাকা বেশ কয়েকটি ছোট দল নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে রাজনীতিতে ছোট ছোট এই দলগুলোর গুরুত্ব বেড়েছে। পাশাপাশি দেশে নির্বাচনী উৎসবের আমেজও তৈরি হয়েছে। যদিও অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এ ব্যাপারে ভিন্ন মতও প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, নির্বাচন মানেই এক ধরনের উৎসব; কিন্তু দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ছাড়া আসন্ন নির্বাচন ঘিরে প্রকৃত অর্থে সেই উৎসব দেখা যাচ্ছে না, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলকও হচ্ছে না।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ইস্যুতে ভিন্ন মত রয়েছে নির্বাচন কমিশনে সদ্য নিবন্ধিত বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি-বিএসপির। দলটির চেয়ারম্যান শাহজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারীর মতে, অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচনে এলে এবং জনগণ ভোট দিলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।
সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি এবং শেখ জুলফিকার বুলবুল চৌধুরীর বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়িয়ে এখন নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর আগে বিএনপির রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়া শমসের মুবিন চৌধুরী ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত তৈমূর আলম খন্দকার ‘তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দেন। অনেকের ধারণা ছিল, নতুন এই দলে বিএনপির বিভিন্ন স্তরের অনেক নেতা যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেবেন। তবে এখনো বিএনপির বড় কোনো নেতাকে যোগ দিতে দেখা যায়নি। তৃণমূল বিএনপি অবশ্য নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের ‘প্রধান বিরোধী দল’ হওয়ার স্বপ্নের কথাও জানিয়েছে দলটি।
এদিকে, তৃণমূল বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে ভোট করবে প্রগতিশীল ইসলামী জোটও। দলীয় প্রতীক ‘সোনালি আঁশ’-এ নির্বাচন করবেন তৃণমূল বিএনপি ও জোটের প্রার্থীরা। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মাঝে ৪৩০টি ফরম বিক্রি করেছে দলটি। তৃণমূল বিএনপি থেকে নির্বাচন করতে ইতোমধ্যে দলটিতে বিএনপির প্রয়াত নেতা গাজীপুরের চৌধুরী তানভীর আহমেদ সিদ্দিকীর ছেলে চৌধুরী ইরাদ আহমেদ সিদ্দিকী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের আলোচিত রাজনীতিবিদ প্রয়াত সাবেক এমপি উকিল আব্দুস সাত্তারের ছেলে মাইনুল হাসান তুষার যোগদান করে মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন। এ ছাড়া সারা দেশ থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের মাঠ পর্যায়ের কিছু নেতাও তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন।
এ ছাড়া তৃণমূলের নেতৃত্বে গঠিত জোটের দলগুলো হলো ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি, নেজামে ইসলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণ আজাদী লীগ, বাংলাদেশ তরীকত ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক লীগ, বাংলাদেশ জনমত পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী জনতা দল (বিএনজেপি), ইসলামী লিবারেল পার্টি, জনতার কথা বলে, বাংলাদেশ স্বাধীন পার্টি, বাংলাদেশ গণতন্ত্র মানবিক পার্টি, সাধারণ ঐক্য আন্দোলন, বাংলাদেশ ইসলামিক গণতান্ত্রিক লীগ ও বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্রেটিক ফোরাম। দলগুলোর নেতারাও ‘সোনালি আঁশ’-এ নির্বাচন করবেন।
তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমূর আলম খন্দকার দৈনিক কালবেলাকে বলেন, তৃণমূল বিএনপি বাংলাদেশের ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ হতে চায়। একই সঙ্গে আগামী জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলও হতে চায়।
তৃণমূল বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা বিএনপি সরকারের সাবেক মন্ত্রী প্রয়াত নাজমুল হুদা। নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত চতুর্থ দল এটি। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধন পায় তৃণমূল বিএনপি। এর তিন দিন পরে ১৯ ফেব্রুয়ারি মারা যান নাজমুল হুদা। এরপর থেকে তার মেয়ে অন্তরা সেলিমা হুদা দল চালাচ্ছিলেন। পরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর তৃণমূল বিএনপির প্রথম সম্মেলন ও কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরীকে চেয়ারপারসন এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা বহিষ্কৃত তৈমূর আলম খন্দকারকে মহাসচিব করে তৃণমূলের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। অন্তরা হুদা দলটির নির্বাহী চেয়ারপারসন হন। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে শমসের ও তৈমূরের যোগদানের মধ্য দিয়ে নতুন করে আলোচনায় আসে তৃণমূল বিএনপি।
তৃণমূল বিএনপির মতো আসন্ন নির্বাচনে দলীয় ‘নোঙর’ প্রতীকে ভোট করবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। দলটি ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। বিএনএম থেকে নির্বাচন করতে ইতোমধ্যে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ছয়জন সাবেক এমপি দলটিতে যোগদান করেছেন। এদের মধ্যে বিএনপির ফরিদপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর, ঝিনাইদহ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মো. আবদুল ওহাব, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য দেওয়ান শামসুল আবেদিন এবং বরগুনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুর রহমান; জাতীয় পার্টির নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাফর ইকবাল সিদ্দিকী এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনের দুবারের সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য এস এম শাফি মাহমুদ রয়েছেন। তবে মো. আবদুল ওহাব বিএনএমে যোগদানের বিষয়টি গণমাধ্যমের কাছে অস্বীকার করেছেন। এ ছাড়া সংগীতশিল্পী ডলি সায়ন্তনী ছাড়াও চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের কর্ণধার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ আরও অনেকে বিএনএমে যোগ দিয়েছেন। ডলি সায়ন্তনী পাবনা-২ আসন থেকে বিএনএমের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন। নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনএম থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে ৪৬৬টি ফরম বিতরণ করা হয়েছে। এদিকে বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদও বিএনএমে যোগ দিয়ে নির্বাচন করবেন বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন রয়েছে। বিএনএমে যোগ দিলে তাকে দলটির চেয়ারম্যান করা হবে, এমন আলোচনাও রয়েছে। সেজন্য বিএনএমের চেয়ারম্যান পদ এখনো খালি রাখা হয়েছে বলে দলটির একজন দায়িত্বশীল নেতা জানিয়েছেন। শাহ মোহাম্মদ আবু জাফর এখন বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের নিবন্ধিত দুই শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এবং বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল) জোট ছেড়ে এখন নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত ২২ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় পার্টিকে (মতিন) নিয়ে তিন দলীয় জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠন করে ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম। এই জোটের দলগুলো নিজ নিজ প্রতীকে ভোটে অংশগ্রহণ করবে। ১০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। গত সোমবার সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম ঢাকা-৫ ও ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন।
নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির (বিএসপি) নেতৃত্বাধীন ছয় দলের মোর্চা ‘লিবারেল ইসলামিক জোট’ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ১২১ আসনে প্রার্থীর মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। এ জোট মোট ২০০ আসনে প্রার্থী দেবে। বাকি ৭৯ আসনে প্রার্থীদের মনোনয়ন বাছাই করে আজ বুধবার গণমাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হবে। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএসপি ও জোটের চেয়ারম্যান শাহজাদা সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ মাইজভান্ডারি এসব তথ্য জানান। এ সময় ১২১ সংসদীয় আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। বিএসপির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দীন আহমদ ঢাকা-১৪ ও চট্টগ্রাম-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। জোটভুক্ত অন্য পাঁচটি দল হলো : বাংলাদেশ ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি, বাংলাদেশ জনদল (বিজেডি), ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী) এবং আশেকিনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ।
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে এনপিপির নেতৃত্বাধীন ১৭ দলীয় জোট গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চ। গত রোববার বিকাশ মঞ্চের মনোনয়ন বোর্ড ৫৯৩টি ফরম যাচাই-বাছাই করে দল ও জোটের এই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করে। পরে মনোনয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ও বিকাশ মঞ্চের সমন্বয়ক শেখ ছালাউদ্দিন ছালু এই চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চের প্রার্থীরা জোটের প্রধান শরিক এনপিপির দলীয় ‘আম’ প্রতীকে নির্বাচন করবেন।
গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান শেখ ছালাউদ্দিন ছালু দৈনিক কালবেলাকে বলেন, এনপিপি একটি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দল। নির্বাচন ব্যতীত সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্র রক্ষা, গণতন্ত্র সুসংহত, গণতন্ত্রের বিকাশ ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এনপিপি ও গণতন্ত্র বিকাশ মঞ্চ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে। তিনি বলেন, আমরা আশা করি, নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হবে, নির্বাচনে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে। আমাদের দাবি, নির্বাচন কমিশন যেন তাদের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব স্বচ্ছতার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালন করে।