তপশিল ঘোষণার পর বেশকিছু রাজনৈতিক দল দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েছে। বিএনপিসহ কয়েকটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নির্বাচনের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জন উঠেছে,Ñদ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। তবে দলটি বলছে, তারা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। বরং রাজপথের আন্দোলন কর্মসূচি জোরদারের পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে দলটি। কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে। গত সোমবার বাংলাদেশে অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাস ও কূটনৈতিক মিশনে চিঠি দিয়েছে বিএনপি। চিঠিতে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অগ্নিসংযোগ ও সংঘাত নিয়ে ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেইসঙ্গে চলমান গুম, খুন এবং সহিংসতার বিষয়ে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছে দলটি। এদিকে, সরকারের পদত্যাগের একদফা ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তপশিল বাতিলের দাবিতে আজ (বুধবার) থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। বিএনপি ছাড়াও জামায়াতে ইসলামী, যুগপতের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এলডিপি, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, এবি পার্টিসহ বেশ কয়েকটি দল এ কর্মসূচি পৃথকভাবে পালনের ঘোষণা দিয়েছে। অবরোধ শুরুর আগে গতকাল রাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় একটি বাসে আগুন দেওয়া হয়। ফায়ার সার্ভিসের পোস্তগোলা স্টেশনের দুটি ইউনিট আগুন নেভায়। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন একজন।
গত সোমবার নির্বাচন কমিশনার রাশিদা সুলতানা বলেছেন, বিএনপি নির্বাচনে আসতে চাইলে আইন দেখে সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। প্রয়োজনে ভোটের তারিখ পেছানোর বিষয়টি ভেবে দেখবে কমিশন। এরপর রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রশ্ন দেখা দেয়,Ñনির্বাচন কমিশনের এমন মন্তব্য বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার ইঙ্গিত কি না। তবে দলটির নীতিনির্ধারকরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণÑবেশিরভাগ সিনিয়র নেতাকে মিথ্যা মামলায় কারাগারে আটক রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে পুরোনো কয়েকটি মামলায় প্রায় ৩ শতাধিক নেতাকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, শেখ হাসিনার সরকার আবারও গায়ের জোরে তার উচ্ছিষ্টভোগীদের নিয়ে একতরফা ভোটহীন আরেকটি পাতানো নির্বাচনের তামাশা করছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোট ডাকাতি করা হয়েছিল। ভোটকেন্দ্রে ভোটার দেখা যায়নি। আর এবার চোর-ডাকাত দিয়ে ভিন্ন কোনো পন্থায় ভোটের নামে আরেকটি ভাঁওতাবাজির প্রহসন করতে মরিয়া তারা। নির্বাচনের পরিবেশ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের আটক রেখে মুক্তিপণ নিচ্ছে পুলিশ। নেতাকর্মীদের না পেয়ে স্বজনদের আটক ও মারধর করছে। তাদের গ্রেপ্তার বাণিজ্যের লাইসেন্স দিয়েছে শেখ হাসিনা। গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বিএনপি নেতাকর্মীদের জীবন এখন দুঃসহ। তবে এতসব করেও এবার আর পার পাওয়া যাবে না। জনগণ রাজপথে নেমেছে অধিকার আদায়ের দুর্বার আন্দোলনে। ফরমায়েশি তপশিলে একতরফা কোনো নির্বাচন হবে না। জনগণ সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করবে। আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের অর্থ হলো নির্বাচনী আত্মহত্যা। তিনি ঘোষিত তপশিল প্রত্যাহার ও নির্বাচন স্থগিত এবং পদত্যাগের দাবি জানান।
জানা যায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নানামুখী তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিশিষ্টজনও বলছেন, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না এলে তা অংশগ্রহণমূলক হবে না।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সিনিয়র আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক গতকাল মঙ্গলবার বলেছেন, নির্বাচনে বিএনপি না এলে তা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হবে না। এখানে ইসি থেকে সরকারের ভূমিকা বেশি। বিএনপির সব দাবি মেনে নিতে হবে, আমি তা বলছি না। তবে সরকার অনেক কিছু ছাড় দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের ইঙ্গিত দিতে পারে।
এ ছাড়া গত সোমবার বাংলাদেশে ‘বিশ্বাসযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ‘বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচন আয়োজনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে’ বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার।
এসব বিষয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক
সহ-সম্পাদক ড. শাকিরুল ইসলাম খান শাকিল বলেন, শুধু বহির্বিশ্বের চাপ নয়, ইসির নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৭টিই তপশিল প্রত্যাখ্যান করছে। আওয়ামী লীগসহ ১৫টি দল স্বাগত জানিয়েছে। বাকি ১২টি দল তপশিলের বিষয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তাছাড়া বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), জাসদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও তপশিল প্রত্যাখ্যান করেছে। সুতরাং এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া মানে জেনেবুঝে সাগরে লাফ দেওয়া।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিজানুর রহমান ভূঁইয়া মিল্টন বলেন, আওয়ামী লীগ এবারও একতরফা নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শেষ করেছে। যদিও নির্বাচন নিয়ে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো তাদের অসন্তোষের কথা বারবার জানিয়েছে। ক্ষমতায় থেকে একতরফা নির্বাচন করতে সরকার এখন প্রশাসন-রাষ্ট্রযন্ত্রকে কাজে লাগাচ্ছে। বিশেষ করে পুলিশ ক্ষমতাসীনদের খায়েশ পূরণে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করছে। তারা বিএনপিসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার-নিপীড়ন অব্যাহত রেখেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা পুলিশের এই অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে উদ্বেগ প্রকাশ করে তা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। সুতরাং দেশের জনগণ ও বিদেশিদের পরামর্শ-প্রস্তাব উপেক্ষা করে একপক্ষীয় নির্বাচন করা দেশবাসীর জন্য অশনি সংকেত।
নোয়াখালী জেলা বিএনপির উপদেষ্টা প্রকৌশলী আমিরুল মোমিন বাবলু বলেন, রাষ্ট্র ব্যবস্থার সর্বত্র সরকার এমনভাবে দলীয়করণ করেছে যে, বর্তমানে কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করাই বিএনপির আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর প্রত্যাশাও সেটি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কোন বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে?
আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি: রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই কূটনৈতিক চ্যানেলে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখছেন। গত সোমবার বাংলাদেশের বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ও মিশনে লিখিত চিঠি ও ডকুমেন্ট পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিএনপি শেখ হাসিনার শাসনামলে সংঘটিত নিন্দনীয় অগ্নিসংযোগ ও সহিংস কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানায়। আমরা একটি নিরপেক্ষ ও সূক্ষ্ম তদন্তের দাবি জানাই এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার রাজনৈতিক সদস্য ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্মীদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টার তীব্র বিরোধিতা করি,Ñযারা দেশব্যাপী ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে বিরোধী দলকে নির্মমভাবে দমন করতে এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগায়।
বিএনপি বিশ্বাস করে, রাজনীতি মানেই জনগণের সেবা করা। ফ্যাসিবাদী ও ক্ষমতালোভী শেখ হাসিনার শাসনামলে সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তির পরিকল্পিত ধ্বংস এবং অগ্নিসংযোগের কারণে দেশের মানুষ আতঙ্কিত। মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মূল্য দিয়ে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার জন্য হাসিনা তার নিপীড়নমূলক কৌশলকে বৈধতা দিতে এবং তীব্র করার চেষ্টা করছেন। এটা উদ্বেগজনক। দুর্ভাগ্যবশত, রাজনৈতিক সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগের অগ্নিসংযোগের একটি ভয়ংকর ইতিহাস রয়েছে। প্রতিদিন অগ্নিসংযোগ ও হামলা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার মূল পরিকল্পনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নিছক নীরব দর্শকের ভূমিকা উদ্বেগ বাড়িয়েছে। কারণ বেশিরভাগ অপরাধী নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে পারছে। গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের পর পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করেছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। আপত্তিকর অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছেÑপুলিশকে হত্যা, অপরিশোধিত বোমা বিস্ফোরণ, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়া, সরকারি কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়া ইত্যাদি।
ষষ্ঠ ধাপে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শুরু: বিএনপির ডাকে আজ (বুধবার) ভোর ৬টা থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। গত সোমবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন, খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে প্রেরণ, দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সব নেতাকর্মীর মুক্তির দাবিতে ষষ্ঠ ধাপে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে।