পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কৌশল বদল | যতটা সম্ভব গ্রেপ্তার এড়ানোর নির্দেশনা | কোনো নেতা গ্রেপ্তার হলে দায়িত্ব নিচ্ছেন পরের স্তরের নেতারা | কর্মসূচি ঘোষণার পর বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা | বিভাজন ভুলে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার বার্তা-
শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও নতুন নতুন মামলার কারণে পরিস্থিতি প্রতিকূল হলেও একদফার চূড়ান্ত আন্দোলন থেকে পিছু হটছে না বিএনপি। শুধু তাই নয়, জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগেই সফলতা আসবে বলে এখনো আশাবাদী দলটি। সেই লক্ষ্যে আন্দোলন এগিয়ে নিতে নানামুখী কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামনের সারির পরিবর্তে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কার্যকর ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যে কোনো পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতা গ্রেপ্তার হলে তার পরের স্তর থেকে সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব নেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
সরকার পতনের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে আজ রোববার থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ঘোষণা করেছে বিএনপি। আগামী মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলবে। দ্বিতীয় দফার এ অবরোধ কর্মসূচি পৃথকভাবে পালন করবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, এবি পার্টি, এলডিপি, গণঅধিকার পরিষদ, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, গণফোরাম-বিপিপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল ও জোট।
বিএনপি নেতারা জানান, তাদের সামনে একদিকে আন্দোলন, আরেকদিকে হামলা-মামলা ও গ্রেপ্তার। এরই মধ্যে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও কিশোরগঞ্জ জেলা সভাপতি মো. শরীফুল আলমসহ প্রায় ২০০ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ অবস্থায় যতটা সম্ভব কৌশলে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন পর্যায়ে বার্তা দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ওপরের দিকে তাকিয়ে না থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনে মূল ভূমিকা পালন করছেন। নতুন কর্মসূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সেটি সফল করতে উদ্যোগ নিচ্ছেন।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ কেন্দ্র করেন সহিংস ঘটনার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে এরই মধ্যে বিএনপির হাইকমান্ড থেকে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মধ্যম সারির নেতারা আন্দোলনের নেতৃত্বে আসছেন। এক নেতা গ্রেপ্তার হলে বিকল্প আরেকজনকে নেতৃত্ব নিতে বলা হয়েছে। সিনিয়ররা গ্রেপ্তার হলে কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে মধ্যম সারি ও জেলা পর্যায়ের নেতারা সামনে আসবেন। সব রকম বিভাজন ভুলে এ মুহূর্তে আন্দোলন সফল করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে থাকতে বারবার বলা হচ্ছে। একই সঙ্গে আন্দোলনের কৌশল ও কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য হাইকমান্ড থেকে নির্দেশনা রয়েছে। এমনকি স্থায়ী কমিটির সদস্যদেরও কর্মসূচি ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে জানানো হচ্ছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান কালবেলাকে বলেন, ‘যারা ভাবছে সরকার প্রশাসন যন্ত্র ব্যবহার করে সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে বিএনপিকে নেতৃত্বশূন্য ও নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, তাদের উদ্দেশে বলতে হয়, বিএনপির ভিত্তি হচ্ছে তৃণমূলের জনগণের শিকড়ে। তার ওপরে রয়েছে মধ্যম সারির ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব। সবার শীর্ষে এ শক্ত দুই ভিত্তির ওপরে দাঁড়িয়ে আছে বিএনপিকে যারা সমন্বয় করে দিকনির্দেশনা দেন সেই কেন্দ্রীয় নেতারা। গত কয়েকদিনে সবাই প্রত্যক্ষ করেছে যে, যাকেই যেখানে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, সেখানে তাৎক্ষণিকভাবে নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠছে জনগণের মধ্য থেকে।’
তিনি বলেন, ‘যতদিন না দেশের মানুষের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সফল হবে ততদিন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলতেই থাকবে। মিথ্যা মামলা-হামলা আর গ্রেপ্তার-আটকের মাধ্যমে জনগণের আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমরা চাই, জাতিকে এই সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে মুক্ত করে একটি নিয়মতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পথে ফিরিয়ে আনতে।’
বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, ফের একতরফা নির্বাচনের লক্ষ্যে বিরোধী দলকে মাঠশূন্য করতে পুরোনো কৌশলে এগোচ্ছে সরকার। তারা পুলিশকে দিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিচ্ছে। এরপর নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হচ্ছে। কেন্দ্রের সিনিয়র থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্য মো. রফিকুল আমিন ভূঁইয়া রুহেল কালবেলাকে বলেন, ‘পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের হামলা-মামলা উপেক্ষা করে রেলপথ এবং রাজপথ অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। পরিস্থিতি যতই কঠিন হোক সরকারের পতন পর্যন্ত আমরা মাঠে থাকবো।’
বিএনপি নেতা ও অ্যাবের সহসভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মো. মোস্তাফা-ই-জামান সেলিম বলেন, ‘বিএনপির নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছে। এতেও সরকার ভীত হয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে একের পর এক হয়রানি করছে। প্রতিদিন অসংখ্য নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করছে।’
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি (ভারপ্রাপ্ত) ইয়াজ্জেম হোসেন রোমান বলেন, ‘আমরা হামলা-মামলায় ভীত নই। বিএনপির হাইকমান্ড যেই কর্মসূচির ঘোষণা দেবে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেটি পালনে সদা প্রস্তুত।’
দিনাজপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বখতিয়ার আহমেদ কচি বলেন, ‘আমার জেলার নেতাকর্মীরা অবরোধ পালনে সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া আছে।’
পঞ্চগড় জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ফরহাদ হোসেন আজাদ বলেন, ‘অতীতের মতোই জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিতীয় দফার অবরোধ সর্বাত্মকভাবে সফল করা হবে।’
কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী জাকির হোসেন সরকার বলেন, ‘কতজনকে গ্রেপ্তার করবে করুক। জনগণই আন্দোলনের নেতৃত্বে দেবে।’
আজ থেকে ফের ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের হত্যা, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ আন্দোলনরত বিভিন্ন দলের সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, বাড়ি বাড়ি তল্লাশি-হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং একদফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আজ রোববার ভোর ৬টা থেকে মঙ্গলবার ভোর ৬টা (৫ ও ৬ নভেম্বর) পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধ ডেকেছে বিএনপি। দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত বৃহস্পতিবার এ কর্মসূচি ঘোষণা দেন। পৃথকভাবে একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে যুগপতের অন্য মিত্ররাও। এর আগে গত ৩১ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত ৭২ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়।