ডিপ্লোম্যাটিক ফ্লাইটের নামে তিন বছর ধরে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করেছে দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক জিন এয়ার। এতে ৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা-সিউল-ঢাকা রুটের জিন এয়ারকে ছাড় দেওয়া হয়েছে অ্যারোনটিক্যাল ও নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ তথা কর এবং ফি। একই রুটে আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দিতে গেলে বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জিন এয়ারের ফ্লাইট বন্ধের নির্দেশ দেন। তবে এতকিছুর মাঝেও প্রতিষ্ঠানটিকে তড়িঘড়ি করে দেওয়া হয়েছে কমার্শিয়াল চার্টার ফ্লাইটের অনুমতি। ফ্লাইটের অনুমতি না থাকলেও জিন এয়ার বিক্রি করছে শিডিউল টিকিট। অভিযোগ উঠেছে,
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল উইং এবং বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক একটি চক্রের মদদে এসব করে যাচ্ছে জিন এয়ার।
জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি কোনো ফ্লাইট নেই। এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তিও নেই। করোনা প্রাদুর্ভাবের সময় দুই দেশে আটকে পড়া নাগরিকদের আনা-নেওয়ার জন্য রিপ্যাট্রিয়েশন তথা ডিপ্লোম্যাটিক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পায় জিন এয়ার। প্রতি সপ্তাহে একটি ফ্লাইট পরিচালনার আগে অনুমতি নিতে হতো প্রতিষ্ঠানটিকে। কূটনৈতিক সুবিধায় পরিচালিত এই ফ্লাইটের জন্য বিমানবন্দর কর, এম্বারকেশন ফিসহ বিভিন্ন ধরনের কর ও ফি মওকুফ করা হয়। তবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে রয়্যালটি ফি দেওয়ার কথা ছিল জিন এয়ারের। প্রতি টিকিটের বিপরীতে এই ফি সর্বনিম্ন ১০ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ ডলার পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে শর্ত ছিল, কোনো অবস্থাতেই বাণিজ্যিকভাবে এই ফ্লাইট পরিচালিত হবে না।
জিন এয়ার এসব শর্ত তো মানেনি, উল্টো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে রয়্যালটি ফি না দিয়েই ডিপ্লোম্যাটিক ফ্লাইটের আড়ালে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। এভিয়েশন খাত বিশেষজ্ঞদের মতে, গত তিন বছরে জিন এয়ারের এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অন্তত ৫ মিলিয়ন ডলার বা ৫৫ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ এবং বিমান বাংলাদেশ এই অর্থ পেত। লো কস্ট বাজেট এয়ারলাইন্স হয়েও চড়া মূল্যে যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করে জিন এয়ার। ঢাকা থেকে সিউলের একক সরাসরি যাত্রায় যেখানে ৫৭ হাজার টাকায়ও টিকিট পাওয়া যায়, সেখানে জিন এয়ারের টিকিটের দাম শুরু হয় ৭৭ হাজার টাকা থেকে।
একজন এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কালবেলাকে বলেন, জরুরি অবস্থায় যখন দুই দেশের মধ্যে যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে সাধারণত ডিপ্লোম্যাটিক ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়। করোনার শুরুর দিকে ঢাকা ও সিউলের মধ্যে এমন ফ্লাইটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই প্রয়োজন তিন বছর ধরে থাকতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আইন ও শর্তের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে একটি গোষ্ঠী এই অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আসছিল জিন এয়ারকে। এতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল উইং এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। জিন এয়ারের অনুকূলে ডিপ্লোম্যাটিক অনুমতি পত্র ইস্যু করত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রটোকল উইং। আর সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষে জিন এয়ারের বিষয়ে তদবির করতেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব রোকসিন্দা ফারহানা। এ বিষয়ে ক্যাবের উপপরিচালক দৌলত উজ্জামান বলেন, তারা ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলে আসে, তাই আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তারা ক্লিয়ারেন্স নেয় ডিপ্লোম্যাটিক চ্যানেলের মাধ্যমে। আমরা শুধু দেখি অনাপত্তি সনদ আছে কি না।
অভিযোগ অস্বীকার করে রোকসিন্দা ফারহানা বলেন, শুরুতে জিন এয়ার বলত আমি তাদের বিরুদ্ধে, তাদের প্রতিপক্ষের হয়ে কাজ করি। আসলে ডেস্ক অফিসারের আইনের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্তি সচিব (বিমান ও সিএ) আশরাফ আলী ফারুকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন রোকসিন্দা। আশরাফ আলী ফারুকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর আর ফোন ধরেননি তিনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিফ প্রটোকল অফিসার নাঈম উদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি কিছু জানেন না। বলেন, বিষয়টি হয়তো আমার সেকশনে এসেছে, তবে আমি জানি না।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন কালবেলাকে বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে এবং এই প্র্যাকটিস বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত ১৬ অক্টোবরের পর প্রতিষ্ঠানটিকে এ ধরনের ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এতদিন ধরে তারা এই অবৈধ কাজ কীভাবে করে এসেছে, তা নাকি কেউ জানে না। তারা দাবি করছে, প্রটোকল উইং তাদের এই অনুমতি দিয়েছে। যদিও প্রটোকল বিভাগ এ বিষয়ে সুস্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। তাই আমরা এটি বন্ধ করতে বলেছি এবং তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।
তবে এতকিছুর পরও জিন এয়ারকে বাণিজ্যিক চার্টার ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গত ১৯ অক্টোবর বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি চেয়ে আবেদন করে জিন এয়ার। এর তিন দিন পরই ২৩ অক্টোবর জিন এয়ারকে অনুমতি দেওয়া হয় বলে কালবেলাকে জানিয়েছে একটি সূত্র। তবে এখানেও চাতুর্যের আশ্রয় নিয়েছে জিন এয়ার। মাত্র একটি ফ্লাইট পরিচালনার অনুমতি পেলেও ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত অনলাইনে টিকিট বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। শিডিউল ফ্লাইটের আদলে ফ্লাইট পরিচালনার তথ্য দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা করছে জিন এয়ার। এতে সাধারণ যাত্রী ও গ্রাহকরা সংকটে পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
শিডিউল ফ্লাইটের অনুমতি এখনো না পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে জিন এয়ারের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, আমরা চার্টার ফ্লাইটের অনুমতি পেয়েছি। তবে আমরা ৩০ দিন পর্যন্ত অগ্রিম টিকিট বিক্রি করি। যাত্রার দিনে যদি বিমান চলাচল না করে, তাহলে আমরা গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্যাবের উপপরিচালক দৌলত উজ্জামান বলেন, এটি কীভাবে করছে, তারাই তা ভালো বলতে পারবে।
বিতর্কিত একটি এয়ারলাইন্সকে মাত্র তিন দিনে চার্টার ফ্লাইটের অনুমতি দেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ক্যাবের ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন সদস্য এয়ার কমডোর শাহ কাওছার আহমদ চৌধুরী বলেন, এটা মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। তারা অনুমতি দিয়ে থাকলে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা চাই যে কোনো কাজই দ্রুত করতে।
জিন এয়ারের সার্বিক বিষয়ে জানতে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি। কারণ উল্লেখ করে খুদেবার্তা দেওয়া হলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তার পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। এদিকে গত সোমবার রাতে চার্টার ফ্লাইটের অনুমতি পাওয়া বিমান সিউলের উদ্দেশে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়। জানা যায়, উড্ডয়নের আগ পর্যন্ত এই ফ্লাইটের জন্যও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রাপ্য রয়্যালটি ফি দেয়নি জিন এয়ার।