চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে যাবেন বেসরকারি চাকরিজীবী হাসান আজাদ। গত বৃহস্পতিবার কয়েকটি ব্যাংকে গিয়েও প্রয়োজনীয় ডলার তিনি পাননি। বাধ্য হয়ে খোলাবাজারে যান। ফকিরাপুল আর মতিঝিলে ঘুরেও সেখান থেকে ডলার কিনতে পারেননি। খুব দরকার হওয়ায় বেশি দর দিতে চাইলেও কোনো মানি এক্সচেঞ্জই ডলার দিতে রাজি হয়নি। এমন চিত্রই দেখা যাচ্ছে দেশের ডলার বাজারে।
আবারও তীব্র ডলার সংকট দেখা দিয়েছে ব্যাংকগুলোয়। ফলে সাধারণ মানুষ ব্যাংকে প্রয়োজনীয় ডলার পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই এখন তারা খোলাবাজারে যাচ্ছেন। সেখানেও প্রয়োজনীয় ডলার মিলছে না। মাঝে কিছুদিন ডলারের বাজার স্থিতিশীল থাকলেও বর্তমানে আবারও সংকটের মুখোমুখি ডলারের বাজার। ফলে একদিকে ব্যবসায়ীরা প্রয়োজনীয় এলসি খুলতে পারছেন না, অন্যদিকে শিক্ষা, চিকিৎসা এবং ভ্রমণসহ বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে যাওয়া সাধারণ মানুষও চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন। ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুললেও এ শ্রেণির মানুষ মূলত খোলাবাজার থেকেই প্রয়োজনীয় ডলার সংগ্রহ করেন।
ব্যাংকগুলোয় ডলার ১০৯ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হলেও খোলাবাজারে হচ্ছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়। সাধারণত এসব প্রতিষ্ঠান বিদেশফেরত ব্যক্তি ও পর্যটকদের কাছ থেকে ডলার সংগ্রহ করে। গত সপ্তাহে তারা প্রতি ডলার বিক্রি করেছে ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায়। মূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে অভিযান চলায় হাতে ডলার থাকা সত্ত্বেও খুব বেশি কেনাবেচা করছে না এসব প্রতিষ্ঠান। মতিঝিলের যমুনা মানি চেঞ্জারের বিক্রেতা কালবেলাকে জানান, প্রতি ডলারের দাম ১১৯ টাকায় উঠেছিল। এখন তাদের হাতে কোনো ডলার নেই বলে জানিয়েছেন তিনি।
ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য গত কয়েক মাস স্বাভাবিক থাকার পর বর্তমানে তা আবারও বাড়ছে। ব্যাংকে ডলারের মজুত কম। দাম নির্ধারণ ও বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বেড়ে যাওয়াকে এর কারণ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও তাদের আশঙ্কা। এ অবস্থায় খোলাবাজারে ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ও খোলাবাজারে ডলার কেনাবেচা বন্ধের পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কারণ, খোলাবাজারে দাম বাড়লে অবৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা বেড়ে যায়। আবার অবৈধ পথে আয় আসা বাড়লে অর্থ পাচারও বেড়ে যায়। তাই অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করে কেউ সুযোগ নিচ্ছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ডলারের সংকট তৈরি হয়েছে। প্রবাসীদের দেশে আসা কমেছে। বিদেশি পর্যটকরাও কম আসছেন। এ কারণে ডলারের সরবরাহ কম। এ ছাড়া খোলাবাজার থেকে সবাই ডলার কিনতে পারেন। ব্যাংক থেকে কিনতে পাসপোর্ট এনডোর্সমেন্ট করতে হয়। ফলে অনেকেই খোলাবাজার থেকে ডলার নেন। ফলে চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে।
এদিকে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখন সর্বোচ্চ ১১০ টাকা ৭৫ পয়সা দরে কেনা এবং সর্বোচ্চ ১১২ টাকা ৫০ পয়সা দরে বিক্রির সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর চেয়ে বেশি দামে তারা কেনাবেচা করতে পারবে না। কিন্তু নগদ ডলার এ দামে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে মানি চেঞ্জারগুলো নির্ধারিত দামে ডলার বিক্রিও করতে পারছে না। এতে মানি চেঞ্জারগুলোয়ও ডলার সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অন্যদিকে, খোলাবাজারে কয়েকদিন ধরেই বেশি দর নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযানে বেশ কয়েকজনকে আটক করে থানায় নেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এর অংশ হিসেবেই বাংলাদেশ ব্যাংক সাতটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে এবং ১০টি মানি চেঞ্জারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে। বেআইনিভাবে মাত্রাতিরিক্ত নগদ ডলার রাখায় আটটি মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হয়। এতে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
সূত্র জানায়, আগে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোই বেশি দামে অফিসিয়াল রেকর্ডের বাইরে গিয়ে ডলার বেচাকেনা করত। নির্ধারিত দামে গ্রাহকরা ডলার বেচাকেনা করলে মানি চেঞ্জারস থেকে রসিদ দেওয়া হয়। এর চেয়ে বেশি দামে বেচাকেনা করলে রসিদ দেওয়া হয় না। ফলে প্রতিটি মানি চেঞ্জারই বৈধ ও বেআইনি দুভাবে ব্যবসা পরিচালনা করত। বৈধ ব্যবসার চেয়ে অবৈধ ব্যবসাই হতো বেশি। কারণ, যারা নগদ ডলার বিক্রি করতেন, তারা বেশি দামেই করতেন। ফলে মানি চেঞ্জারগুলোও বিক্রির ক্ষেত্রে বেশি দাম নিত। এতে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধ ব্যবসা প্রায় চাপা পড়ে যায়। বৈধ লাইসেন্সের আড়ালে তারা অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা করে। অভিযানের কারণে এখন অবৈধ ব্যবসা প্রায় বন্ধ। ফলে মানুষ ডলার পাচ্ছে না। এ সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও ডলার দিতে পারছে না।
রাজধানীর মতিঝিল, দিলকুশা ও পল্টন এলাকায় অবস্থিত মানি চেঞ্জারগুলোয় গিয়ে দেখা যায়, বেশির ভাগই বন্ধ। কিছু খোলা থাকলেও লোকজন নেই। বিক্রেতা আসে না বললেই চলে। ক্রেতারা এলে বলে দেওয়া হচ্ছে ডলার নেই। অভিযোগ রয়েছে, মানি চেঞ্জারস ব্যবসায়ীদের অনেকে গোপনে ডলার কেনাবেচা করছেন।
সূত্র জানায়, দেশে নগদ ডলার নিয়ে আসেন সাধারণত প্রবাসী ও বিদেশ থেকে ফিরে আসা যাত্রীরা। নিয়মানুযায়ী তাদের কাছে যেসব ডলার থাকবে, ফেরার সময় বিমানবন্দরে কাস্টমসে ঘোষণা দিতে হবে। এর মধ্যে ১০ হাজার ডলারের বেশি থাকলে তা ফেরত দিতে হবে ব্যাংক বা মানি চেঞ্জারসে। পরে ব্যবহারের জন্য গ্রাহক নিজের কাছে ১০ হাজার ডলার রাখতে পারবেন। কিন্তু অনেকে দেশে ফেরার পর এর চেয়ে অনেক বেশি ডলার নিজের কাছে রেখে দিচ্ছেন। তারা সেটি বাজারেও বিক্রি করছেন না। আবার নিজেরা ব্যবহারও করছেন না। এতে নগদ ডলারের সংকট বাড়ছে। এ ছাড়া অনেকে ভবিষ্যতে বিশেষ প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে টাকা দিয়ে নগদ ডলার কিনে রাখছেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোলাবাজারে ডলার সংকটের কারণ জানতে চাইলে মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক হেলাল শিকদার বলেন, ডলারের আমদানি আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। যতটুকু আসছে দাম বাড়তে পারে–এমন আশায় তা-ও ধরে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। আর বাংলাদেশ ব্যাংক খোলাবাজারে ডলারের দর বেঁধে দেওয়ায় সংকটটা একটু বেশি হয়েছে। কেননা বাংলাদেশ ব্যাংক যে দর বেঁধে দিয়েছে, সেই দরে তারা ডলার কিনতে পারছেন না, আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশি দরে বিক্রিও করতে পারছেন না। সেজন্য খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা এখন অলস সময় পার করছেন। এ অবস্থায় আগের মতো ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। আজ রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে এমন প্রস্তাব দেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক যেহেতু খোলাবাজারের সংকট নিরসনে কোনো ডলার সহযোগিতা দেয় না, ফলে ডলারের দর বেঁধে দেওয়াও তাদের উচিত না। খোলাবাজারের ব্যবসায়ীরা বাজার থেকেই ডলার কিনে বাজারেই বিক্রি করেন। ফলে দাম নির্ধারণও বাজারের ওপরই ছেড়ে দিতে হবে। এভাবে যদি তারা কেনাবেচা করতে পারেন, তাহলেই বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে ৩২ মিলিয়ন ডলারের ক্যাশ ব্যালান্স আছে। ফলে ব্যাংকে সংকট নেই। সাধারণ মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী তারা ডলার সরবরাহও করছে। কিন্তু তার পরও কেন মানুষ খোলাবাজারে যাচ্ছে? বর্তমানে নগদ ডলারের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড এবং ডুয়েল কারেন্সি ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করার অবকাশ রয়েছে। ফলে নগদ ডলারের সংকট হলেও সাধারণ মানুষ খোলাবাজারে না গিয়ে যদি এ ধরনের সেবাগুলো ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের কোনো ভোগান্তি হবে না। খোলাবাজারে ডলারের দর তুলে নেওয়ার প্রস্তাব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা প্রস্তাব দেওয়ার পরই সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম বলেন, ডলারের বাজার বর্তমানে চড়া হওয়ার কথা নয়। আমাদের নির্ধারিত দরে বিক্রির জন্য বলা হয়েছে। মানি চেঞ্জাররা বেশি অর্থ নিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
মন্তব্য করুন