২০ ঘণ্টার সফরে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বাংলাদেশে আসছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতির জটিল পরিস্থিতি, রাশিয়ার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের বৈরী মনোভাব এবং বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে পরাশক্তিগুলোর নানামুখী তৎপরতার প্রেক্ষাপটে ল্যাভরভের সফরে দিকে পুরো বিশ্বের চোখ থাকবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
ঢাকা ও মস্কোর সূত্রগুলো জানিয়েছে, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত ঢাকা সফরকে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে বাংলাদেশ ও রাশিয়া। দুদেশের কূটনীতিকরা ব্যস্ত রয়েছেন সফরের প্রস্তুতি ও আলোচ্যসূচি নির্ধারণে।
ল্যাভরভের সম্ভাব্য ঢাকা সফরসূচি অনুসারে, আসিয়ান শীর্ষ সম্মেলন শেষে জাকার্তা থেকে আজ বিকেলে বিশেষ বিমানে ঢাকায় আসবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। সেখান থেকে তারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আসবেন। সেখানে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা-মস্কো দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দেবেন। বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেবেন তারা। রাতে তার সম্মানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেবেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
আগামীকাল শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ল্যাভরভ। এরপর তিনি ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনে যাবেন। সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এ ছাড়া রাশিয়াফেরত বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ল্যাভরভের মতবিনিময়ের কথা রয়েছে। শুক্রবার দুপুরের আগেই রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে নয়াদিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।
এদিকে এটিই হবে কোনো রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় ভারত মহাসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা জোটের (আইওআরএ) মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার কথা ছিল ল্যাভরভের। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তার ঢাকা সফর বাতিল করে মস্কো।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে বাংলাদেশের পাশে থাকা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন নব্বই দশকে ভেঙে রাশিয়া হওয়ার পরও দুদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। দেশটির সহযোগিতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশ অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়ার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে ভারসাম্য বজায় রেখে চলছে।
এদিকে বাংলাদেশের রাজনীতি নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলতেও দ্বিধা করেনি রাশিয়া। বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নাখোশ হওয়ার ঝুঁকি নিয়েই রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেছে। এমন পরিস্থিতিতে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দেয়ার আগে ঢাকায় আসছেন ল্যাভরভ। তার সফরের দিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো বিশ্বের নজর থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, ইউক্রেনের ওপর রুশ হামলার কারণে গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ল্যাভরভের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, যা এখনো বহাল। এমনকি বাংলাদেশের পণ্য বহনকারী নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রুশ জাহাজকে মার্কিন আপত্তির কারণে ভিড়তে দেয়নি সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় বৈঠকে দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হবে। সংক্ষিপ্ত এ সফরে আলোচনায় গুরুত্ব পাবে পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন, সামরিক সহযোগিতা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। এদিকে ইউক্রেন ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে জরুরি অধিবেশন ভোটাভুটিতে চারবার বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান না নিলেও ইউক্রেনের অখণ্ডতা রক্ষার বিষয়ে একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, ইউক্রেনসহ বৈশ্বিক ইস্যুতে তার সরকারের অবস্থান তুলে ধরে বাংলাদেশের সমর্থন চাইতে পারেন ল্যাভরভ।
রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ইউক্রেন সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান বের করতে মস্কোকে অনুরোধ করবে ঢাকা। এ ছাড়া খাদ্য, সার ও ফুয়েলের মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে।
ল্যাভরভের সফর বহুমাত্রিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি কালবেলাকে বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি হওয়ার কারণে রাশিয়াসহ সব পরাশক্তিই মনে করে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়লে তারাও লাভবান হবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রাশিয়া বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এ কারণে বন্ধুত্বে সেই আবেগও আছে। এদিকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে রূপপুরের মতো বড় প্রকল্প ব্যাহত হচ্ছে। ডলারের বাইরে একটি লেনদেন পদ্ধতির গুরুত্ব অনুধাবন করছে সবাই। এ ছাড়া মিয়ানমার-রাশিয়ার সুসম্পর্কও রোহিঙ্গা সংকট সুরাহায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ সফরে স্বভাবতই বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে।
ড. ইমতিয়াজ মনে করেন, বহুমাত্রিক বিশ্বে অর্থনৈতিক কাঠামো বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। তাই এমন হাই-প্রোফাইল সফরও নিউ নরমাল। এ কারণেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁও আগামী রোববার বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সবাই বাংলাদেশের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমে আঞ্চলিক কানেকটিভিটি ও বাণিজ্য সুবিধার সুফল নিতে চায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব মনস্তাত্ত্বিক কারণেই ল্যাভরভের সফরের দিকে দৃষ্টি রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন