১৯৮৮ সালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল ব্যুরোতে (এলজিইবি) সহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরিতে যোগদান করেন সেখ মোহাম্মদ মহসিন। শিক্ষাসনদ অনুযায়ী ওই সময় তিনি নিজের জন্মতারিখ উল্লেখ করেছিলেন ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩। সে অনুযায়ী ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখনো নিয়মিত চাকরিতে বহাল রয়েছেন তিনি। কারণ, এরই মধ্যে নিজের জন্মতারিখ বদলে ফেলেছেন সেখ মোহাম্মদ মহসিন। বর্তমানে তিনি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রধান প্রকৌশলী। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ২০০৮ সালের আগের নথিপত্রে তার জন্ম সাল ১৯৬৩। কিন্তু এরপর যেসব নথি তৈরি হয়েছে তাতে এ কর্মকর্তার জন্ম সাল উল্লেখ করা হয়েছে ১৯৬৪।
এলজিইডি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাকরির মেয়াদ বাড়াতে সেখ মোহাম্মদ মহসিন জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন। আর বিষয়টি আমলে নিয়ে তার শিক্ষাসনদের সত্যায়িত কপিসহ বিভিন্ন ধরনের প্রমাণপত্র চেয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. আব্দুর রহমান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনের কাছে এসব তথ্য চাওয়া হয়েছে।
ওই চিঠিতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিনের ‘জন্মতারিখের জটিলতা নিরসনের জন্য’ এসএসসি সার্টিফিকেটের সত্যায়িত ছায়ালিপি, এলজিইডিতে প্রথম যোগদানের এলপিসির সত্যায়িত কপি, এলজিইডিতে যোগদানের পর প্রথম জ্যেষ্ঠতা তালিকার কপি এবং ২০০১ সালের এলজিইডির প্রকৌশলীদের খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকার কপি জরুরি ভিত্তিতে পাঠাতে বলা হয়েছে।
বয়স নিয়ে জালিয়াতির এ অভিযোগ অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেখ মোহাম্মদ মহসিন একেক জায়গায় একেক রকম জন্মতারিখ উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন কাজে এসএসসি পাসের সনদ জমা দিলেও তাতে পরীক্ষার রোল এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর নেই।
জানা গেছে, সেখ মোহাম্মদ মহসিন ১৯৮৮ সালে পিএসসির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সহকারী প্রকৌশলী পদে তৎকালীন এলজিইবিতে যোগদান করেন। ওই সময়ের নথিপত্রে তার জন্মতারিখ উল্লেখ ছিল ১৯৬৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। এলজিইডিতে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে তিনি চলতি দায়িত্ব পান ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর। এ পদে স্থায়ী দায়িত্ব পান ২০২২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি।
অনুসন্ধানকালে ১৯৯৫ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এলজিইডি জ্যেষ্ঠতার তালিকা কালবেলার হাতে আসে। সেগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৯৫ সালের জানুয়ারিতে করা জ্যেষ্ঠতার তালিকার ২৭২ নম্বরে ছিলেন সেখ মোহাম্মদ মহসিন। সেখানে তার জন্মতারিখ লেখা ১৯৬৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রয়েছে। তখন তিনি এলজিইডির নারায়ণগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের জ্যেষ্ঠতার তালিকায়ও একই জন্মতারিখ পাওয়া যায়। ওই তালিকার ২৫৩ নম্বরে ছিল তার নাম। ২০০১ সালের তালিকায় তার অবস্থান ছিল ২১২ নম্বরে। আর ২০০৪ সালের তালিকায় তিনি ১৭৯ নম্বরে উঠে আসে। এই দুটি তালিকায়ও জন্মতারিখ অপরিবর্তিত ছিল।
২০০৮ সালে এসে হঠাৎ করে সেখ মোহাম্মদ মহসিনের জন্মতারিখ বদলে যায়। ওই বছর করা জ্যেষ্ঠতার তালিকার ১৪০ নম্বরে ছিল তার নাম। এতে জন্মতারিখ দেখানো হয়েছে ১৯৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
সেখ মোহাম্মদ মহসিনের জন্মতারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে কালবেলার পক্ষ থেকে তার পাসপোর্টের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, তদের ওয়েবসাইটে সেখ মোহাম্মদ মহসিনের দুটি পাসপোর্টের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম পাসপোর্টটি তৈরি করা হয়েছে ২০১০ সালে। এটির মেয়াদ শেষে তিনি ২০১৮ সালে নতুন পাসপোর্ট নেন, যার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০২৩ সালে। তবে সম্প্রতি তিনি ই-পাসপোর্ট নিযেছেন। এ পাসপোর্টগুলোতে তার জন্মতারিখ ১৯৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর উল্লেখ রয়েছে।
সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের আগেও পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন সেখ মোহাম্মদ মহসিন। বিভিন্ন দেশে ভ্রমণও করেছেন। তার সাবেক ও বর্তমান সহকর্মীরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অফিসিয়াল বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত তার জীবনবৃত্তান্তেও এসব ভ্রমণের তথ্য উল্লেখ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জন্ম সাল ১৯৬৪ উল্লেখ করে গত বছরের ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের মাঘাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জন্মনিবন্ধনও করিয়েছেন সেখ মহসিন। পাসপোর্ট তৈরি ও জন্মনিবন্ধনের জন্য তিনি এসএসসির সনদ জমা দিয়েছেন। সেই সনদের কপিও কালবেলার হাতে এসেছে। তবে বিভিন্ন দপ্তরে জমা দেওয়া সনদের ফটোকপিতে রোল নম্বর বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর লেখা অংশ নেই। ২০১৯ সালে এমন একটি ফটোকপি সত্যায়িত করেছেন এলজিইডিরই একজন প্রকৌশলী।
সূত্র বলছে, ২০০৮ সালের পর থেকে বিভিন্ন কাগজপত্রে জন্ম সাল ১৯৬৪ উল্লেখ করা হয়েছে। সেই হিসেবেই এখনো তিনি চাকরিতে বহাল আছেন। তবে ২০০৮ সালের আগের যেসব নথি পাওয়া গেছে, তাতে এ প্রকৌশলীর জন্ম সাল ১৯৬৩ উল্লেখ করা আছে।
বয়স জালিয়াতি করে চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী সেখ মোহাম্মদ মহসিন কালবেলাকে বলেন, ‘এটি সম্মানহানির একটি অপচেষ্টা মাত্র। মন্ত্রণালয় যে কারও কাছেই এমন তথ্য জানতে চাইতে পারে। তথ্য চাইলেই সেটি জালিয়াতি হয়ে যায় না।’
বিভিন্ন সময় এলজিইডি যে জ্যেষ্ঠতার তালিকা করেছে, সেগুলোতে জন্মতারিখ উল্লেখ ছিল ১৯৬৩, তবে ২০০৮ সালের পর থেকে তা কীভাবে ১৯৬৪ হয়ে গেছে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রিন্টিং মিসটেক হতে পারে। এটা স্বাভাবিক বিষয়, সেগুলো প্রিন্টিং মিসটেক ছিল।’
সেখ মোহাম্মদ মহসিন বলেন, ‘সরকার না বুঝেই আমাকে নিয়োগ দেয়নি। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা খোঁজখবর নিয়ে নিয়োগ দিয়েছে। এখন জন্মতারিখকে ইস্যু করে আমার সম্মানহানি করা হচ্ছে। এটা ঠিক নয়।’
মন্তব্য করুন