দেশীয় অনেক বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংকটের মিছিলে এবার যোগ দিল বহুজাতিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল সুনামের সঙ্গে কার্যক্রম চালালেও বর্তমানে বহুমুখী সংকটে পড়েছে ব্যাংকটি। ঋণ বিতরণসহ ব্যাংকিং সেবায় একসময় সর্বোচ্চ মানদণ্ড অনুসরণ করত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক; কিন্তু সেখান থেকে সরে এসে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেদার ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এমনকি আমানতের ঋণ বিতরণে বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া সীমাও মানা হয়নি। এক পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর বড় অংশই আদায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের ওপর তৈরি করা ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দীর্ঘকাল বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা এ ব্যাংকটি এখন খেলাপি ঋণের কলঙ্কে জড়িয়েছে। অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। ২০২২ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাত্র ছয় মাসে নতুনভাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২৫৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা, যা চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৮৯৫ কোটি ৭৯ লাখ টাকায় পৌঁছায়। এটি মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। অন্যদিকে গত বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির মন্দ ও ক্ষতিজনক বা আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ ৫৮৬ কোটি ৯০ লাখ টাকায় ঠেকেছে, যা স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণের ৬৫ দশমিক ৮০ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যাংকটির এই পরিমাণ ঋণ আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
তবে এর থেকে শিক্ষা নেয়নি ব্যাংকের পর্ষদ। বরং এ সময়ে ব্যাপক হারে ঋণ পুনঃতপশিলীকরণের সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। এই দৌড়ে ব্যাংকটির নতুনভাবে ঋণ পুনঃতপশিল করা হয়েছে ১১৫ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এর পাশাপাশি ইতোমধ্যে ব্যাংকটির আমানতের বিপরীতে ঋণ বিতরণের গড় ভারিত সুদ হার ব্যবধান ৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের রেগুলেটরি সীমা ৪ শতাংশ নির্ধারিত আছে। এ ছাড়া অগ্রাধিকার খাত হিসেবে এসএমইতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণ না করার অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে।
একটি ‘ভালো’ ব্যাংকের হঠাৎ এমন সংকটে পড়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ‘করোনার সময় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বিদেশি বড় এক গ্রাহক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
ফলে ব্যাংকটি কিছুটা সংকটে পড়েছে। যেহেতু তাদের পোর্টফোলিও খুব বেশি বড় নয়, এ কারণে বড় একজন গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে পুরো ব্যাংক বিপদে পড়ে যায়। এখানেও তেমনটিই হয়েছে। তবে খুব শিগগিরই ব্যাংকটি তাদের অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে পারবে বলে জানিয়েছে ব্যাংকটি।’
১৯৪৮ সালে বন্দরনগরী চট্টগ্রামে শাখা স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকটির ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, বগুড়া ও নারায়ণগঞ্জ শহরে মোট ২৪টি শাখা ও ৯৬টি এটিএম বুথ রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ২ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ শ্রেণীকরণের তিনটি পর্যায় রয়েছে। তা হলো নিম্নমান, সন্দেহজনক ও মন্দ মান বা ক্ষতিজনক (যা আদায় অযোগ্য)। এই তিনটি পর্যায় বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোকে নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণ করতে হয়। এর মধ্যে নিম্নমান ঋণের বিপরীতে ২০ শতাংশ প্রভিশন, সন্দেহজনকের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ মান বা ক্ষতিজনক ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয়। অর্থাৎ এর মানে হলো কোনো ব্যাংকের আদায় অযোগ্য ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে ওই ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যায়। কারণ এর বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখতে হয় বলে তার নিট আয়ও কমে যায়। একই সঙ্গে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার ব্যয়ও বেড়ে যায়। যে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ক্ষেত্রেও এখন এমন আশঙ্কাই করা হচ্ছে।
বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এ ব্যাংকটির এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা দাবি করছেন, সুশাসনের ঘাটতি থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়।
জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘হঠাৎ করে তাদের খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়া মোটেও ভালো বিষয় নয়। এটা উদ্বেগজনক। কারণ সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের মাত্রা অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ছিল তার ব্যতিক্রম। এখন কেন এমন হচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে এই বিষয়ে আরও বেশি অনুসন্ধান করা উচিত। একই সঙ্গে দায়ী সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’
অবশ্য স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে খুব বেশি নয় বলে মনে করেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তবে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকটি যেহেতু স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, সে বিবেচনায় তা কিছুটা বেশি। এর মধ্যে মন্দ ঋণ যেটা আছে, সেটা হয়তো তারা অবলোপন করে ফেলবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, অন্যদের মতো তাদেরও মন্দ ঋণ বেড়েছে। অর্থাৎ আগের মতো দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তারা দেখাতে পারছে না। বরং বলা যায়, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পর্যায়ে নেমে এসেছে তারা। এতে বোঝা যায়, বাজারের পরিস্থিতি ভালো নয়। এমনকি ভালো ব্যাংকগুলোর পক্ষেও খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব হচ্ছে না। এমনকি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ বাড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের মতো ব্যাংকও বাংলাদেশের ব্যাংকিং সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছে। বিদেশি ভালো ব্যাংকগুলোর জন্য অবশ্যই এটা নেতিবাচক বার্তা দেবে। তবে ধারণা করি, কোনো বড় গ্রাহকের কারণে হয়তো ব্যাংকটি সংকটে পড়েছে।’
এ বিষয়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেও ব্যাংকটির বাংলাদেশ প্রধান ও সিইও নাসের এজাজ বিজয়ের কোনো মতামত পাওয়া যায়নি। কালবেলার পক্ষ থেকে মোবাইলে খুদেবার্তা পাঠালে এবং দফায় দফায় ফোন করলেও তিনি তা ধরেননি।
সংকট উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংকের যেসব নির্দেশনা:
যদিও সার্বিক বিবেচনায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের ক্যামেলস রেটিং নির্ণীত হয়েছে ১ দশমিক ৯৬, যা আগের প্রান্তিকে ছিল ২ দশমিক ০২ শতাংশ। এখন সংকট থেকে উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে। এতে খেলাপি ঋণের নতুন শ্রেণীকরণ না করতে পরামর্শ দেওয়া হয় ব্যাংকটিকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়, আগের সব শ্রেণীকৃত ঋণের বিপরীতে আদায় কার্যক্রম লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি পুনঃতপশিলকৃত ঋণ যাতে আবার শ্রেণীকৃত ঋণে পরিণত না হয়, সেজন্য মনিটর নিশ্চিত করার তাগিদ দেওয়া হয়। মন্দ ও ক্ষতিজনক ঋণ যাতে আর না বাড়ে সে ব্যাপারে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণসহ এর বিপরীতে আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে বলা হয়। অবলোপনকৃত ঋণের বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রাভিত্তিক আদায় কার্যক্রমে জোর দিতে বলা হয়। অফ ব্যালান্স শিট এক্সপোজারে যাতে ফান্ডেড ঋণে পরিণত না হয়, তার জন্য যথাযথ মনিটর করতে বলা হয়। এ ছাড়া, অগ্রাধিকারভিত্তিক সিএমএসএমই খাতে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ঋণ বিতরণেও মনোযোগ বাড়াতে বলা হয়।
এ ছাড়া, আমানত ও ঋণের গড় ভারিত সুদ হার ব্যবধান রেগুলেটরি সীমা ৪ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কোর রিস্ক রেটিং ন্যূনতম সন্তোষজনক পর্যায়ে উন্নীত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ণীত ক্যামেলস রেটিংয়ের পত্র প্রাপ্তির পর পরই তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন এবং উল্লিখিত ২০ দিনের মধ্যে ওই বিভাগে তা জমা দিতে বলা হয়েছে।
মন্তব্য করুন