ব্রিকস নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? সুশীল সমাজের কেউ সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন, কেউ আবার এমন কথাও বলছেন যে, এবার ভারত, চীন, রাশিয়া ইচ্ছে করেই বাংলাদেশের সদস্যপদ ঠেকিয়ে দিয়েছে। আবার এমন কেউ আছেন, যারা একটু ফাঁকফোকর পেলেই সরকারের নিন্দাভাষণে মুখর হয়ে ওঠেন। কারও যুক্তি বেশ অশালীন ও অদ্ভুত—‘না পারবি যদি তবে গেলি কেন?’ অর্থাৎ সরকারকে যেভাবেই হোক হেয় এবং অপদার্থ প্রমাণ করতেই হবে, তা সে ব্রিকসের ব্যাপারে ধারণা থাক বা না থাক। এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন নানা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টাও করছেন; আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী খোদ সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে কথা বলবেন। বকাউল্লাহরা তবু বকবক করে চলেছে বিরামহীনভাবে।
আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার, ব্রিকসটা আসলে কী, কেন এটা এখন আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। আর এর উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যটাই বা কী। আগেই বলে নেওয়া ভালো, এ ব্যাপারে আমি বিশেষজ্ঞ নই; তবে সাধারণ
বুদ্ধি-বিবেচনায় যতটুকু জানি, তা হলো বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক জোট এ ব্রিকস। এটি শক্তিশালী উদীয়মান বাজার হিসেবে পশ্চিমাদের বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীনের ক্রমাগত অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার কথা বলতে গিয়ে গোল্ডম্যান স্যাশের অর্থনীতিবিদ জিম ও’নেইল এই ব্রিক শব্দটি ব্যবহার করেন। চৌদ্দ বছর আগে ২০০৯ সালে রাশিয়ায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত এবং চীন প্রথম সম্মেলন করে। ২০১০ সালে এই জোটের অন্তর্ভুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। তখন থেকে এই জোট পরিচিত হয় ব্রিকস নামে। অর্থাৎ ব্রাজিলের বি, রাশিয়ার আর, ভারতের আই এবং চীনের সি—আর সর্বশেষে দক্ষিণ আফ্রিকার এস মিলে এই ব্রিকস। এই জোটের উদ্যোগেই ২০১৫ সালের ২১ জুলাই যাত্রা শুরু করে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক-এনডিবি।
গত ২২ থেকে ২৪ আগস্ট জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত হয় ১৫তম শীর্ষ সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নতুন সদস্যভুক্তি। সম্মেলনের শেষ দিনে নতুন পূর্ণ সদস্য হিসেবে আরও ছয়টি দেশকে যুক্ত করার কথা ঘোষণা করা হয়। এ ছয়টি দেশ হচ্ছে মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, আর্জেন্টিনা, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই দেশগুলো ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে জোটভুক্ত হবে। অর্থাৎ এর সদস্যসংখ্যা দাঁড়াবে ১১-তে।
এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগ্রহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ার কারণটাও বেশ স্পষ্ট। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের বিস্ময়কর আচরণ, পাশ্চাত্য মুদ্রাব্যবস্থার কারণে বিপন্ন বোধ করা দেশগুলো একটা বিকল্প অর্থব্যবস্থার আশ্রয় চেয়েছিল বলেই তো এই উত্থান ঘটল।
এখানে আরও একটি বিষয় লক্ষ করার মতো যে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশই ব্রিকস সদস্য দেশের আওতায়; বিশ্ব জিডিপির ২৭ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে এই দেশগুলো। একদিকে পশ্চিমা অর্থব্যবস্থার কারসাজিতে নাভিশ্বাস ওঠা দেশগুলো সংগত কারণেই নতুন আশ্রয়ের অন্বেষণ করবে—এটা তো সহজেই অনুমেয়। কাজেই এই জোটে অন্তর্ভুক্ত হতে আগ্রহীর সংখ্যা তো বাড়ছেই। তেমনটাই হয়েছে। ৪০টির বেশি দেশ এই জোটের সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। আর আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করেছে ২৩টি দেশ। এই ২৩টিরই একটি হচ্ছে বাংলাদেশ। এদের মধ্যে এবার পেয়েছে ছয়টি দেশ। কেবল দু-তিন মাস আগে আবেদন করা হয়েছে। কাজেই অপেক্ষা তো একটু করতেই হবে। এর মধ্যে ইতিবাচক দিকটি হলো, বাংলাদেশ জোটের ব্যাংক এলডিবিতে যুক্ত হয়েছে ২০২১ সালে। এরপর তো অনেকরকম প্রক্রিয়া থাকে, অনেক হিসাব-নিকাশ থাকে, ভূরাজনীতি থাকে, বৈশ্বিক পরিস্থিতিও আমলে নিয়ে চলতে হয়। কাজেই হুটহাট করে মন্তব্য করলেই তো হয় না, একটা সুস্থির পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হয়। আর একটি বড় ইতিবাচক দিক হলো, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনার সময় বলেছেন, তারা বাংলাদেশকে এই জোটে যুক্ত করার কথা ভাবছেন। আরও একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, এবার বাংলাদেশ এই ব্রিকসের সম্মেলনে পর্যবেক্ষক হিসেবে থেকেছে।
যে ১৬টি দেশ এবার সদস্য হতে পারল না, সেসব দেশের রাজনীতিকরা কি সেসব দেশের সরকারগুলোর ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন? সরকারের বুকের ওপর কি ব্যর্থতার তকমা ঝুলিয়ে দিয়েছেন? সাধারণ মানুষ কি এ বিষয়টিকে ইস্যু ধরে নিয়ে আন্দোলন করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন? আমার ধারণা, এ নিয়ে কোনো দেশের রাজনীতিক নেতিবাচক ভূমিকা দেখাবেন না। কারণ, এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ জোটের সদস্যভুক্তির জন্য অনেক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। যেসব দেশ এবার সদস্যপদ পেয়েছে তারা অনেকেই আবেদনের আনুষ্ঠানিকতা সাম্প্রতিক সময়ে করলেও তৎপরতা গত বছর থেকে শুরু করেছে। ইরান ও আর্জেন্টিনা তো গত বছর আবেদনও করেছে।
আমি বিষয়টিকে এভাবেও দেখতে চাই। সামনে জাতীয় নির্বাচন। হয়তো বড়জোর সাড়ে চার মাস বাকি আছে। এর মধ্যে আছে পশ্চিমা দেশগুলোর তৈরি করা নানাবিধ চাপ, বিভিন্ন ধরনের হুমকি, রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের অযাচিত হস্তক্ষেপ। আসন্ন নির্বাচনে দলকে যেতে হবে বিপদসংকুল পথ ধরে। এরই মধ্যে দলকে সামলাতে হবে রাষ্ট্রীয় স্বার্থবিরোধী অন্তর্ঘাত, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তিগুলোর নিঃশব্দ পদচারণা, দলের ভেতরে মুখ গুঁজে থাকা উইপোকা।
আমি অবাক হবো না, যদি এমন কিছু কথা শোনা যায় যে, ভারতই আমাদের ব্রিকসের সদস্য হতে দিল না। বুঝতে হবে যে, এ ধরনের একচক্ষুবিশিষ্ট সমালোচকের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আবার এরাই হয়তো ব্রিকসের সদস্যপদ পেলে বলতে দ্বিধা করবে না যে, এই সরকার ভারতের অনুকম্পায় এই পদটি বাগিয়ে নিয়েছে। এরা এটাও ভাববে না যে, বিশ্বের পরাশক্তি ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করেই এখন পা ফেলতে হবে।
সবশেষে দেশের বিখ্যাত কার্টুন শিল্পী শিশির ভট্টাচার্যের একটা কার্টুনের কথা মনে পড়ল, এক নেত্রীকে নিয়ে আঁকা কার্টুন। তিনি কলা ভক্ষণ করবেন তাই বললেন, ‘ছিল্যা দাও’ তার সামনে যখন কলাটা ছিলে দিয়ে ধরা হলো তিনি বললেন, ‘ছিল্যা ক্যান বুজাইয়া দাও’। রাজনীতির সমালোচকরা কি এভাবেই কলা ছিলার বা বুজিয়ে দেওয়ার রাজনীতি করেই যাবেন?
মন্তব্য করুন