জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলসহ ছয় দফা দাবিতে কয়েক মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের চার লাখের বেশি পলিটেকনিক শিক্ষার্থী। প্রথমে স্মারকলিপি ও মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন শুরু হলেও দাবি আদায় না হওয়ায় ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন করেন তারা। গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা মোড় অবরোধ এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভের মাধ্যমে আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। কুমিল্লায় পুলিশি লাঠিচার্জে আন্দোলন আরও তীব্র হয়। সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস এবং কমিটি গঠনের পরও শিক্ষার্থীরা আন্দোলন থেকে সরেনি। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, ছয় দফা দাবির প্রতিটি পয়েন্ট লিখিতভাবে বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া তারা আন্দোলন শেষ করবেন না।
শিক্ষার্থীদের ৬ দফা দাবি: ১. ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ কোটা বাতিল এবং হাইকোর্টের রায় অবৈধ ঘোষণা। ২. ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল এবং নিয়োগবিধি সংশোধন। ৩. ডিপ্লোমা কোর্সে যে কোনো বয়সে ভর্তির সুযোগ বাতিল। ৪. ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের অধিকার রক্ষায় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ। ৫. কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ। ৬. স্বতন্ত্র কারিগরি ও উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং উন্নতমানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতা: ১৭ এপ্রিল শিক্ষার্থীরা সারা দেশে রেলপথ অবরোধের ডাক দেয়। সরকারের আশ্বাসে আন্দোলন সাময়িকভাবে শিথিল হলেও ফলপ্রসূ আলোচনা না হওয়ায় আন্দোলন ফের জোরদার হয়। শুক্রবারও শিক্ষার্থীরা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে বিক্ষোভ করে এবং দাবি আদায় না হলে কঠোর কর্মসূচির হুমকি দেয়।
গত সপ্তাহের আলোচনার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় আন্দোলন মোকাবিলায় ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করলেও শিক্ষার্থীরা জানান, কমিটি গঠনই যথেষ্ট নয়; লিখিত প্রতিশ্রুতি ছাড়া তারা আন্দোলন ছাড়বেন না।
আজ রোববার সারা দেশের সব পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে একযোগে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দিয়েছে ‘কারিগরি ছাত্র আন্দোলন, বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্ম। ফেসবুক পেজে ঘোষণা দিয়ে বলা হয়েছে, পূর্বের সব নির্দেশনা বহাল থাকবে।
শিক্ষার্থীদের বক্তব্য: ঢাকা পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী মাশফিক ইসলাম দেওয়ান বলেন, ‘মহাপরিচালক প্রথমে সব দাবি যৌক্তিক বললেও পরে বলেন—কিছু যৌক্তিক, কিছু অযৌক্তিক। এ ধরনের বক্তব্য আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছি।’ ময়মনসিংহের শাহাজাদা আহমেদ বলেন, ‘আমরা কোনো কোটার জন্য নয়, আমাদের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্য আন্দোলন করছি।’
আরেক শিক্ষার্থী মাহিন হাসান বলেন, ‘২০২১ সালে নন-টেকনিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে নিয়োগ পাওয়া ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টররা কাজের যোগ্যতা রাখেন না। আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে।’
কারিগরি শিক্ষা বিভাগের অবস্থান: কারিগরি শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু দাবি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। নিয়োগবিধি সংশোধন এবং ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের পদবি পরিবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে।
অফিসিয়াল বক্তব্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের বিতর্কিত নিয়োগ বাতিল করা বিভাগের এখতিয়ারভুক্ত নয়। তবে আদালতের নির্দেশে ক্র্যাফট ইনস্ট্রাক্টরদের ৩০ শতাংশ কোটা বাস্তবায়নের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
ডিপ্লোমা ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে যে কোনো বয়সে ভর্তির সুবিধা বাতিলের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কারিগরি শিক্ষা ইংরেজি মাধ্যমে চালুর উদ্যোগের কথাও জানানো হয়েছে। তবে প্রশাসনিক পদে কারিগরি ব্যাকগ্রাউন্ডের জনবল নিয়োগ সময় সাপেক্ষ হবে বলে জানানো হয়।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব খ ম কবিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি শিক্ষার্থীদের বড় স্বপ্নের কথা ভাবছি। তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেছি। আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে যেতে হবে।’
কমিটি গঠন ও আজকের সভা: কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ গত ২২ এপ্রিল শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৮ সদস্যের কমিটি গঠন করে। আজ রোববার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হবে। তিন সপ্তাহের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, আইডিইবি, আইইবি, প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি রয়েছেন।
আন্দোলনে উসকানির অভিযোগ: সরকারি কর্মকর্তারা মনে করছেন, আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আন্দোলনকারীদের উসকানো হয়েছে। তাদের অভিযোগ, ঢাকা পলিটেকনিকের অভ্যন্তরে ‘টেক-ননটেক’ বিভাজন তৈরি করে আন্দোলন আরও উসকে দেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের যুক্তিযুক্ত দাবি নিয়ে সরকার আন্তরিক হলেও আন্দোলন দীর্ঘায়িত করার পেছনে কিছু চক্রের হাত রয়েছে।
উন্নয়নকর্মী শাহ মো. জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করা। টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রকৌশল কলেজে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। কারিগরি শিক্ষা উন্নয়ন ছাড়া দেশের শিল্পায়ন ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়।’
মন্তব্য করুন