বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে নার্স ও মিডওয়াইফদের অবদান অনস্বীকার্য। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে প্রতিদিনের স্বাস্থ্যসেবা—প্রতিটি পর্যায়ে নার্সিং পেশার গুরুত্ব নতুনভাবে অনুভব করেছেন নাগরিকরা। কিন্তু তাদের পেশাগত মূল্যায়নের বিষয়টি বহুদিন ধরেই বিতর্কিত। বিশেষ করে শিক্ষাগত যোগ্যতার স্বীকৃতি না থাকা, যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রণোদনা না পাওয়া, কিংবা দীর্ঘ কর্মজীবনেও একঘেয়েমি গ্রেডে পড়ে থাকা—এসবই পেশার প্রতি আগ্রহে ভাটা ফেলছে। ঠিক এই বাস্তবতাকে সামনে রেখে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি খাতের জন্য একটি ১৬ দফা সংস্কার প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অধিদপ্তর।
এই প্রস্তাবনায় সবচেয়ে আলোচিত ও নতুন দিকটি হচ্ছে—শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে ইনক্রিমেন্ট। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কর্মরত নার্স ও মিডওয়াইফদের মধ্যে যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমার চেয়ে বেশি, তাদের সেই ডিগ্রির পরিমাণ অনুযায়ী অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হবে। অর্থাৎ কেউ যদি স্নাতক ডিগ্রিধারী হন, তিনি পাবেন একটিমাত্র অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট। মাস্টার্স ডিগ্রিধারী হলে দুটি, আর পিএইচডি থাকলে মিলবে তিনটি ইনক্রিমেন্ট। এতে শিক্ষা ও দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাগত স্বীকৃতি যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনই উচ্চশিক্ষায় আগ্রহও বাড়বে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
সংস্কার প্রস্তাবে আরও জায়গা পেয়েছে পোশাক পরিবর্তন, কর্মস্থলে আরামদায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করা, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নার্সিং কার্যালয় স্থাপন এবং নবম থেকে শুরু করে চতুর্থ গ্রেড পর্যন্ত পদোন্নতির সুযোগ। পাশাপাশি, স্বাস্থ্যসেবার সম্মুখসারিতে কাজ করা নার্স ও মিডওয়াইফদের জন্য ৩০ শতাংশ হারে ঝুঁকি ভাতা প্রদানের বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য।
তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সংস্কার পরিকল্পনা যতটা অর্থনৈতিক সুবিধা ও প্রশাসনিক কাঠামো উন্নয়নে কেন্দ্রীভূত, ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি সেবার মনোভাব, পেশাগত দক্ষতা কিংবা রোগীর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মতো মানবিক দিকগুলোতে। একজন নার্স শুধু ক্লিনিক্যাল দক্ষতায় নয়, রোগীর প্রতি সহানুভূতি, মনোযোগ ও আন্তরিকতার মাধ্যমেও একজন আদর্শ সেবিকা হয়ে ওঠেন। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো উপেক্ষিত থেকেই গেছে।
ড্রেসকোড, ইনক্রিমেন্ট বা বদলির ডিজিটাল ব্যবস্থা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন পেশাদারিত্বের বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক মানে নার্সিং সেবাকে উন্নীত করার বাস্তব উদ্যোগ। অথচ প্রস্তাবনাটিতে চিকিৎসক ও অন্যান্য সেবাকর্মীর সঙ্গে নার্সদের সমন্বয়, সমতাভিত্তিক কাজের পরিবেশ বা ইথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড নিয়েও কোনো সুস্পষ্ট কথা নেই।
সংস্কার প্রস্তাবটির পেছনে রয়েছে বাস্তব সংকট। দেশে বর্তমানে ৪০০-এর বেশি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে থেকে প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী ডিগ্রি অর্জন করছেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সরকারি হাসপাতালে সর্বশেষ নার্স নিয়োগ হয়েছে ২০২০ সালে, তা-ও মাত্র চার হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, প্রতি ১০ হাজার জনগণের জন্য ৪৪ দশমিক পাঁচজন নার্স প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশে বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত—প্রতি ১৮ হাজার জনের জন্য রয়েছেন একজন নার্স।
সরকারি হাসপাতালগুলোর অনুমোদিত শয্যার সংখ্যা প্রায় ৭৫ হাজার। এ হিসাবে অন্তত ৮৮ হাজার ৫০০ নার্স দরকার। বর্তমানে কর্মরত আছেন মাত্র ৪৩ হাজার। এই হিসাবে ঘাটতি দাঁড়ায় প্রায় ৪৫ হাজার নার্সের। অথচ সরকারি কর্ম কমিশনে এখনো ২ হাজার ৩৬৭ জন নার্স ও ৪০১ মিডওয়াইফের নিয়োগ আটকে আছে। নতুন করে আরও ১৫ হাজার পদের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সৃষ্টির প্রক্রিয়া এগোয়নি।
কিছু প্রস্তাব বিস্তারিত উল্লেখ করা হলো:
ঝুঁকি ভাতা: দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতে নার্স ও মিডওয়াইফরা সামনের সারির কর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা রোগীর সেবা প্রদান করেন। এতে তাদের সংক্রামক রোগের সংস্পর্শে আসা, মানসিক চাপ, শারীরিক পরিশ্রম এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত ও পরিবেশগত ঝুঁকিতে পড়তে হয়। নার্স ও মিডওয়াইফরা প্রতিনিয়ত নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। এ অবস্থায় নার্স ও মিডওয়াইফদের যথাযথ মূল্যায়ন এবং তাদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা প্রদান সময়োপযোগী।
ড্রেসকোড পরিবর্তন: বর্তমানে নার্সদের ড্রেসকোড সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে, যা তাদের পেশাগত দক্ষতা ও স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করা ব্যাহত করছে। আধুনিক ও আরামদায়ক পোশাক কর্মক্ষেত্রে নার্সদের আরও কার্যকর ও মনোযোগী করে তুলতে পারে। বর্তমান ড্রেসকোড আপডেট করে যুগোপযোগী, আরামদায়ক এবং পেশাগত মর্যাদা বজায় রেখে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
নিয়োগবিধি: নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি এখনো পুরোনো কাঠামো অনুযায়ী চলছে, যা আধুনিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ নার্স দীর্ঘ কর্মজীবনে পদোন্নতি পান না। কেউ কেউ মাত্র একবার পদোন্নতি পেলেও অবসরের আগেই তা কার্যকর হয় না। এতে পেশাগত উন্নয়ন ও কর্মস্পৃহা ব্যাহত হয়। তাই ভূতাপেক্ষ, প্রমার্জন বা ডিপিসির মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা জরুরি হয়ে পড়েছে।
নার্সিং শিক্ষা: নার্সিং শিক্ষায় একই এন্ট্রি যোগ্যতা, একই রেজিস্ট্রেশন এবং একই কার্যবিধি ও একই পদের চাকরি গ্রেডসহ নানা ধরনের অসংগতির জন্য নার্স ও মিডওয়াইফদের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সব গ্রুপের শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাচেলর অব নার্সিং নামে প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। তাই বিদ্যমান দুই গ্রুপের পেশাগত বিভাজন রোধে নার্সিং সেবার গুণগতমান নিশ্চিতে অভিন্ন কোর্স হিসেবে চার বছর মেয়াদি ‘ব্যাচেলর অব নার্সিং’ প্রোগ্রাম প্রবর্তন জরুরি। শিক্ষার সময়কালে স্টাইপেন্ড ও ইন্টার্নশিপ ভাতা কম হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক চাপে থাকেন। বর্তমানে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীরা তাদের প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার জন্য যে স্টাইপেন্ড ও ইন্টার্নশিপ ভাতা পান, তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম।
বদলি: নার্স ও মিডওয়াইফদের বদলির প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে জটিল সময়সাপেক্ষ এবং অপ্রকাশ্য ছিল, যা তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনে নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের সুযোগ কাজে লাগিয়ে বদলির প্রক্রিয়াকে সহজ, স্বচ্ছ ও দ্রুত করতে অনলাইন বদলি প্রক্রিয়া চালু করা সময়োপযোগী।
ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপন: নার্স ও মিডওয়াইফদের দক্ষতা ও সেবার মান উন্নয়নে প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন প্রশিক্ষণ ও পেশাগত বিকাশের সুযোগ। স্বাস্থ্যসেবা খাতের দ্রুত পরিবর্তনশীল চাহিদা এবং আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করতে ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ জরুরি। দেশের নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সেক্টরে আন্তর্জাতিক মানের ইন-সার্ভিস প্রশিক্ষণ সেন্টার স্থাপন একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ: বর্তমানে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি পেশার প্রশাসনিক কার্যক্রম কেন্দ্রীভূত থাকায় বিভিন্ন পর্যায়ে সেবা প্রদানে অসুবিধা হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসনে উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কার্যালয় স্থাপন এবং প্রশাসনিক পদ সৃজন অত্যন্ত সময়োপযোগী। এতে স্থানীয় পর্যায়ে নার্সিং পেশার নেতৃত্ব বিকাশ হবে, যা পেশার মর্যাদা বৃদ্ধির পাশাপাশি সেবা প্রদান প্রক্রিয়াকে কার্যকর করবে। বিকেন্দ্রীকৃত প্রশাসনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সেক্টরের বিভিন্ন সমস্যা দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হবে।
মনিটরিং সেল: দেশের বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে। তবে সেখানে রেজিস্টার্ড নার্স ও মিডওয়াইফের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত হচ্ছে না। ফলে সেবার মান এবং রোগীরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ছে। এ সমস্যার সমাধানে মনিটরিং সেল গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। উদ্যোগের ফলে বেসরকারি হাসপাতালে রোগীরা মানসম্পন্ন এবং নিরাপদ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি সেবা পাবেন, যা স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। রেজিস্টার্ড নার্স ও মিডওয়াইফের কর্মসংস্থান এবং পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে।
নার্সিং মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে সেল গঠন: বহির্বিশ্বে দক্ষ নার্সের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ফিলিপাইন, ভারত, নেপালসহ প্রতিবেশী দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে নার্স জনশক্তি পাঠিয়ে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। উন্নত বিশ্বে দক্ষ নার্স পাঠিয়ে বাংলাদেশেরও ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে সৌদি আরব, কুয়েত, ডেনমার্ক ও যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ থেকে নার্স নিতে আগ্রহী। দেশের নার্স জনশক্তিকে বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে পাঠাতে হলে বিদেশি ভাষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরে একটি সেল গঠন করে বাংলাদেশের নার্সদের বিদেশে প্রেরণ প্রক্রিয়া সহজিকরণ ও বিদেশে বাংলাদেশের নার্সদের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, প্রান্তিক থেকে টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে সেবার চেয়ে নার্সদের অন্যান্য প্রশাসনিক কাজে বেশি ব্যস্ত রাখা হয়। বিশেষ করে হাসপাতালের ওষুধসহ স্টোরের হিসেবে রাখা। এসব নার্স ও মিডওয়াইফদের কাজ নয়। তাদের গুণগত শিক্ষা, মানসম্মত সেবা, দক্ষতা উন্নয়ন ও রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে জোর দিতে হবে। নার্সের কাজ হাসপাতালের স্টোর সামলানো নয়। এসবের জন্য ভিন্ন লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। সংস্কার প্রস্তাবে নিয়মিত পদোন্নতি, কারিকুলাম পরিবর্তন, ঝুঁকি ভাতা প্রদানসহ অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। এসবের সঙ্গে রোগীবান্ধব নার্সিং খাত তৈরিতেও জোর দিতে হবে।
বাংলাদেশ নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিএনএ) সভাপতি খান মো. গোলাম মোর্শেদ বলেন, নার্সিং ও মিডওয়াইফারি খাত সংস্কারে যে প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা এক পাক্ষিক। এই খাতের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা পরামর্শ না করেই একটি প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। নার্স ও মিডওয়াইফারি খাতকে সংস্কার করতে হলে বৈশ্বিক নার্সিং শিক্ষা কারিকুলামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে। দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এজন্য নার্সদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই প্রস্তাবনা প্রণয়ন করতে হবে।
মন্তব্য করুন