প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে গত কয়েক বছরে বারবার হোঁচট খেয়েছে দেশের শিক্ষাক্ষেত্র। সর্বশেষ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শিক্ষাক্ষেত্রে নানামুখী সমস্যা আরও তীব্র হয়। আন্দোলনের কারণে প্রায় চার মাস বন্ধ ছিল সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরপর তা খুললেও এখনো স্বাভাবিক হয়নি। নানা দাবি ও আন্দোলনে শিক্ষা কার্যক্রম বারবার ব্যাহত হচ্ছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও উপেক্ষিত রয়ে গেছে শিক্ষা। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদরা।
গত ৫ আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে থাকেন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামো। গত আট মাসে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ নানা দাবিতে আন্দোলন জোরদার হয়। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মারামারি, শিক্ষকদের আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সংঘর্ষ, শিক্ষার্থীরা বই হাতে না পাওয়াসহ নানা ঘটনায় শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা চলতে থাকে। সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) টানা আন্দোলনে পুরো অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় প্রতিষ্ঠানটিতে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশের ‘ল অ্যান্ড অর্ডার’ কার্যকর না থাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও অস্থিতিশীলতা কাজ করছে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত (ক্লোজলি কানেক্টেড)। শিক্ষা খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সরকারের কার্যকর উদ্যোগ ও বিশেষজ্ঞ কমিটি করার পরামর্শ তাদের। অন্যদিকে শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা নিয়ে সরকারের উদ্বেগের কথাও জানিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, যে কোনো অভ্যুত্থানের পরই একটা অস্থিতিশীলতা থাকে, ধীরে ধীরে সেটি স্থিতিশীল হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় স্বস্তি ফিরছে না। শিক্ষার্থীরা একদিকে ক্লাসে ফিরছেন, অন্যদিকে আবার লক্ষ্যচ্যুত (ডাইভার্ট) হয়ে পড়ছেন। যার অন্যতম কারণ সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক জায়গাগুলোতে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা। মনিটরিং কিংবা জবাবদিহির জায়গাটা এখনো তৈরি করা যায়নি। শিক্ষার্থীদের এখন পড়ার টেবিলে ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে গত কয়েকদিন ধরে কুয়েটে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা, যা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে মানববন্ধন, অনশন ছাড়া ক্লাসও বর্জন করতে দেখা যায়। সর্বশেষ বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া এবং উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তা মোটামুটি সমাধানের পথে এলেও এর রেশ এখনো কাটেনি। অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে পলিটেকনিকেও। ছয় দফা দাবিতে বেশ কিছুদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন শিক্ষার্থীরা। সরকারের আশ্বাসেও তা থামেনি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি গঠন করার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করলেও পরে সদস্য পরিবর্তন করে ফের আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা।
গত বছরের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলনে নামেন। কয়েক মাস চলে এই আন্দোলন। সংঘর্ষ হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। পরে অধিভুক্ত বাতিল এবং আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। তবে এখনো তা চূড়ান্ত না হওয়ায় সেখানেও অস্থিরতা চলছে। অন্যদিকে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা তিতুমীর বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণের দাবিতে আন্দোলন করেছেন। সে সময় যাত্রীবাহী ট্রেনে ঢিল ছুড়ে আহত করেন শিশুসহ অনেক যাত্রীকে।
কয়েক মাস আগে ঢাকা কলেজ এবং সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুরসহ শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) আজিজ হল ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এসব ঘটনায় বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম। সম্প্রতি ঢাকা কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবারও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত মঙ্গলবার তাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকা পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। এ সংঘর্ষের কারণে মিরপুর সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাবে আশপাশের সড়কে সৃষ্টি হয় অসহনীয় যানজট। ফলে ভয়াবহ দুর্ভোগে পড়ে মানুষ।
কদিন আগে, ১৫ এপ্রিল একই এলাকায় এ দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। এ দুই কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে জড়ানো যেন নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায়ই ছোটখাটো ঘটনায় তারা একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। শুধু এ দুই কলেজ নয়, অতীতে বিভিন্ন সময় এ এলাকায় অবস্থিত তিনটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখা গেছে। এই তিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো ঢাকা কলেজ, ঢাকা সিটি কলেজ এবং আইডিয়াল কলেজ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সূত্রমতে, এ তিন কলেজের শিক্ষার্থীরা ছয় মাসে মারামারি ও সংঘর্ষে জড়িয়েছেন অন্তত ১২০ বার। প্রাথমিকভাবে এ ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে এই দুই কলেজসহ ধানমন্ডি এলাকার আরও তিনটি কলেজ মিলে একটি সমঝোতা চুক্তি হওয়ার কথা। সেই চুক্তি অনুসরণ করলে এ ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সময় মতো বই দিতে না পারায় গত কয়েক মাসে সঠিকভাবে পড়াশোনা করতে পারেনি প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া বেসরকারি স্কুল-কলেজে শিক্ষক সংকটও প্রকট। এতে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতির আশঙ্কা করছেন শিক্ষাবিদরা। শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় উৎসব করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দেওয়ার বিষয়টি রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কারণে এ বছরের প্রথম দিনে সারা দেশের বিদ্যালয়গুলোয় নতুন বই বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ সব শিক্ষার্থী একসঙ্গে বই পায়নি। চার মাস পেরিয়ে গেলেও তাদের হাতে বই পৌঁছেনি।
শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, শিক্ষকদের আন্দোলনেও অচলাবস্থা তৈরি হয়। গত সাত মাসে শ্রেণিকক্ষের চেয়ে আন্দোলনের মাঠেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন শিক্ষকরা। রাজধানীতে এমন কোনো শিক্ষক সংগঠন নেই, যারা তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলন করেননি। একাধিক শিক্ষক সংগঠন রাজধানীতে অবস্থান কর্মসূচি, অনশন, কর্মবিরতি, বিক্ষোভ-ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচি পালন করেছে। অনেক সময় শিক্ষকদের আন্দোলন থামানোর জন্য জলকামান, লাঠিপেটা ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার করতে হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে।
বর্তমানে ছোটখাটো দাবিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের আন্দোলন করছেন, যা আলোচনার টেবিলে সমাধান সম্ভব, সেগুলো নিয়েও তারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও বাইরে বিক্ষোভ করছেন, ক্লাস-পরীক্ষাও বন্ধ করছেন। এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ কালবেলাকে বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি হয়েছে, তারা আন্দোলন করলেই অনেক কিছু করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যে আন্দোলন হচ্ছে, সেগুলো একেকজন একেকভাবে দেখছে, একেকটা উদ্দেশ্যে (পারপাস) আন্দোলন করছে। আন্দোলনগুলো জেনারালাইজড করা খুব কঠিন। আবার অনেক জায়গায় মারামারি হচ্ছে, যেমন ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজ। আন্দোলন আর মারামারি এক রকম না। এই যে অস্থিতিশীলতা, এর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ক্লোজলি কানেক্টেড। এর জন্য দরকার ছিল ল অ্যান্ড অর্ডার স্ট্রং করা। সরকারের উচিত উপাচার্যদের মেসেজ দেওয়া যে, আমরা এখন পুরোপুরি পড়াশোনামুখী থাকব।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দরকার ছিল একটা শিক্ষা কমিশন, সেটাও হয়নি। শিক্ষার সমস্যাগুলো কী, সেটা নিয়ে আমাদের কোনো কাজই হয়নি। সরকারের কাছে শিক্ষা যেন অগ্রাধিকার (প্রায়োরিটি) নেই। অবশ্য কোনো সরকারের কাছেই তা ছিল না! আমরা খুব আশা করেছিলাম, এই সরকারের আমলে অন্তত একটা শিক্ষা কমিশন হবে। সেই কমিশন শিক্ষার সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবে। শিক্ষা এখন অনেক অরক্ষিত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অরক্ষিত। যার কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি এই কাজগুলো (আন্দোলন-মারামারি) হচ্ছে। রাষ্ট্রের অস্থিতিশীলতার কারণেই শিক্ষার এমন বেহাল দশা।
এ বিষয়ে বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক ও লেখক আবুল কাসেম ফজলুল হক কালবেলাকে বলেন, কুয়েটে অনেকদিন ধরেই আন্দোলন করছেন ছাত্ররা। পরবর্তী সময়ে ছাত্রদের দাবি প্রায় সম্পূর্ণ মেনে নেওয়া হয়েছে, বহিষ্কারাদেশ তুলে নেওয়া হয়েছে, উপাচার্যকে অপসারণ করা হয়েছে। ব্যাপারটা শুধু কুয়েট না, সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার অগ্রগতি নেই। ক্লাস চলছে, কিন্তু পড়াশোনার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। এ বিষয়ে সরকারের গভীর মনোযোগ দরকার। কেন এমন পরিস্থিতি, এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে একটা কমিটি গঠন করা দরকার। তদন্ত করে বের করা উচিত শিক্ষার অস্বস্তিগুলো। এভাবে সমস্যা চিহ্নিত করে পরিস্থিতি ভালো করার দিকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা কমিশন করে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা—সেটি নির্বাচিত সরকারের আমলে হলে ভালো। এখন এই সরকারের একান্ত কর্তব্য, যেসব জায়গায় আন্দোলন হচ্ছে, সেসব বিষয়ে সমাধান করে দেওয়া। এভাবে ঢিলেঢালাভাবে চলতে থাকলে শিক্ষায় বিপর্যয় নেমে আসবে। একসময় সরকার হয়তো আর সামাল দিতে পারবে না।
সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থিরতা নিয়ে সরকারও উদ্বিগ্ন উল্লেখ করে গত বুধবার এক আলোচনায় শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার বলেছেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা যেন আর না ঘটে, সে বিষয়ে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। পুরো সমাজ একটি অস্থিরতার মধ্যে চলছে এবং সব যে রাতারাতি ঠিক হয়ে যাবে, সেটা ভাবাও বোধ হয় ঠিক নয়।’
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খলা ও দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিগত সময়ে ছাত্ররা যখনই কোনো দাবি উপস্থাপন করতেন, তখনই রাষ্ট্র ঝাঁপিয়ে পড়ত তাদের ওপর। এখন যেহেতু আগের পরিস্থিতি নেই। তাই সবাই একসঙ্গে তাড়াহুড়া করে হয়তো দাবিগুলো তুলতে গিয়ে দেশে এমন পরিস্থিতি হচ্ছে, যা যথেষ্ট উদ্বিগ্নের বিষয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ছাত্রদের আশ্বস্ত করছি যে, তাদের দাবিগুলো সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখে নিয়ম ও আইনের মধ্যে থেকে উপযুক্ত সমাধানের চেষ্টা করব।’
মন্তব্য করুন