সরকারি অনুদানের তালিকায় থাকা প্রায় ৮০ ভাগ গ্রন্থাগার নামসর্বস্ব ও অস্তিত্বহীন। হাতেগোনা যে কয়টির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, সেগুলোতেও পাঠক নেই। বেশিরভাগ সময়ই থাকে বন্ধ। কিছু পাঠাগারে গরু-ছাগল লালনপালন করা হয়। কয়েকটি খোলা হয় না বছরেও, মাকড়সা জাল বুনিয়ে বাসা বেঁধেছে।
কিছু পাঠাগার আবার সরকারি বড় কর্তাদের। ঈদ উৎসবে বাড়ি গেলে খুলে বসে গালগল্প করেন। কেউ কেউ নিজের শোয়ার ও বসার ঘরকে দেখিয়েছেন পাঠাগার হিসেবে। অথচ এসব পাঠাগার বছর বছর পেয়েছে সরকারি অনুদান। দেশের ২৫টি জেলায় সরেজমিন ঘুরে চার শতাধিক বেসরকারি পাঠাগারের বেলায় এমন তথ্য ও চিত্র দেখা গেছে।
জানা গেছে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রতি বছর দেশের আনাচে-কানাচে থাকা বেসরকারি পাঠাগারে আর্থিক অনুদান ও বই সহায়তা দিয়ে থাকে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তালিকাভুক্ত দেশের ৬০২টি বেসরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে দেশজুড়ে। এসব গ্রন্থাগারে সহায়তার ক্ষেত্রে বরাদ্দের ৫০ ভাগ অর্থ প্রদান করা হয় প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে থাকা ব্যাংক হিসাবে। বাকি ৫০ ভাগ অর্থের বই সহায়তা হিসেবে দেওয়া হয়।
তথ্যমতে, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ২০২১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বেসরকারি পাঠাগারের জন্য বরাদ্দ পেয়েছে মোট ১৮ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে শুধু বই কেনায় বরাদ্দ ছিল ৯ কোটি ৪১ লাখ টাকা। বাকি টাকা বরাদ্দ বেসরকারি পাঠাগারগুলোর নিজস্ব ব্যাংক হিসাবে অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার বাছাইয়ের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন রয়েছে। তবে সেসবের তোয়াক্কা করা হয়নি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই। অনুদান ও গ্রন্থাগার তালিকাভুক্তি করা হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। আমলাদের নামেও রয়েছে বেশ কিছু গ্রন্থাগার। অনেকে আবার নিজের বাসাবাড়ির কক্ষকে পাঠাগার দেখিয়ে হাতিয়েছেন অনুদানের অর্থ। ফলে বেসরকারি গ্রন্থাগারের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি করা এবং জনসাধারণকে গ্রন্থ পাঠে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করাসহ যেসব লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে মন্ত্রণালয়, তার সিকিভাগও পূরণ করা সম্ভব হয়নি।
সরেজমিন যা দেখা গেল: রংপুর জেলায় গণগ্রন্থাগারের তালিকাভুক্ত পাঠাগার ১২টি। এর মধ্যে ৩টির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। চারটি পাঠাগার কোনোরকমে চলছে। এর মধ্যে মিঠাপুকুর উপজেলার রোকেয়ার চেতনা পাঠাগার ও সংস্কৃতি সংসদ, রংপুর সদরের ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সিটি কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নাসিম আহমেদ সনুর জ্ঞানালোক গ্রন্থাগার এবং সদরের পুষ্পিতা সাহাত পাঠাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া কার্যক্রম নেই রংপুর সদরের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য হোসনেয়ারা লুৎফা ডালিয়ার হাজেরা বেগম স্মৃতি গ্রন্থাগার। এখানকার অগ্রদূত গ্রন্থাগার, বৈশাখী পাঠাগার ও দীপ্ত পাঠাগারও নামসর্বস্ব। এসব পাঠাগারের কোনো কার্যক্রম নেই। পীরগাছার প্রজন্ম সমাজ সংস্কৃতিকেন্দ্র পাঠাগারটি বর্তমানে দোকান ভাড়া-সংক্রান্ত জটিলতায় বন্ধ রয়েছে। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলায় তিনটি গ্রন্থাগারের মধ্যে দুটি অস্তিত্বহীন। এর মধ্যে হরিম্বর তালুক গ্রামে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালামের জনসেবা সাধারণ পাঠাগার বর্তমানে ধানের গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তালতলা গ্রামের স্বামী বিবেকানন্দ গ্রন্থাগার বর্তমান চায়ের দোকান। গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার রওশন-আমেনা গণউন্নয়ন গ্রন্থাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। একই উপজেলার বাংলাদেশ শিশু উন্নয়ন পাঠাগারে বর্তমানে গোখাদ্য খড় রাখা হয়। একই উপজেলার এএফ কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র ও ইসলামিক পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই। স্থানীয়রা কোনোদিন এমন পাঠাগারের নামই শোনেনি। পীরগঞ্জের কানাড়ী মেধা উন্নয়ন পাঠাগারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সাঘাটা উপজেলার ফিরোজা স্মৃতিস্বরূপ পাঠাগারের অস্তিত্ব থাকলেও এটি বর্তমানে পরিত্যক্ত। পুরোটি ভেতরে ছেয়ে আছে মাকড়সার জালে। সুন্দরগঞ্জের উত্তরণ পাঠাগারের কার্যক্রম নেই। গাইবান্ধা সদরের বুনন একাডেমি গ্রন্থাগার স্থানীয়দের কাছে মুরগির খামার নামে পরিচিত।
সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট নায়েবউল্লাহ ডিজিটাল পাঠাগারের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে রবিউল ইসলামের নামের একজনের বাড়িতে। পাঠাগারটি সক্রিয় নয়। কাগজ-কলমে একজন গ্রন্থাগারিক নিয়োগ দেখানো আছে। মাঝেমধ্যে স্থানীয় কিছু পাঠক আসেন এবং বই সংগ্রহ করেন। গল্প, কবিতা, উপন্যাস, ধর্মীয় বইসহ বিভিন্ন লেখকের ২৭১টি বই রয়েছে।
গোপালগঞ্জ সদরে রায়বাহাদুর স্মৃতি পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। টুঙ্গিপাড়ার ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট ক্লাব লাইব্রেরি অব চাপরাইল এবং শ্রীমৎ মহানন্দ সরকার স্মৃতি গণপাঠাগারেরও অস্তিত্ব নেই। টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার জলছত্র অগ্নিসেনা পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গোপালপুর উপজেলায় জয় বাংলা পাঠাগার ও মুক্তিযোদ্ধা তুলা কমান্ডার পাঠাগারের কার্যক্রম নেই। পিরোজপুরের কাউখালীতে বাশরী বহুমুখী সমাজ কল্যাণ সংসদ ও গণপাঠাগার এবং আলহাজ সুলতান আহমেদ স্মৃতি সংসদ ও পাঠাগারের কোনো কার্যক্রম নেই। মঠবাড়িয়ায় ইলিয়াস গ্রন্থাগার ও ইউনুস আলী হাওলাদার পাঠাগারে অস্তিত্ব নেই। নেছারাবাদে চন্দ্ররেণু পাঠাগার, খাড়াবাক বিল্ববাসী পাঠাগার, মাস্টার শাহাদৎ হোসেন পাঠাগার ও ক্লাব এবং কবি এমদাদ আলী পণ্ডিত স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি ও ব্যবস্থাপনায় জাহিদ সোহেল নামের এক ব্যক্তি। নাজিরপুরের সেলিনা রহমান পাঠাগারে অস্তিত্ব নেই। সেলিম রেজা স্মৃতি পাঠাগারের কার্যক্রম নেই। ভোলা সদরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই। সিদ্দিকুর রহমানের বসতবাড়ির সামনে একটি সাইনবোর্ড আছে মাত্র। শিশির মেমোরিয়াল ক্লাব ও পাঠাগার এবং আশার আলো পাঠাগারের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। দৌলতখান উপজেলায় কাজীরহাট আদর্শ পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই। লালমোহনে মাওলানা মুসলিম স্মৃতি পাঠাগার, মোতাছিম বিল্লাহ আদর্শ পাঠাগার, দীপ দর্পণ পাঠাগার, আলহাজ রশিদ আহম্মদ ফাউন্ডেশন ও পাঠাগার এবং আবু বকর সিদ্দিক মিয়া ফাউন্ডেশন ও পাঠাগারের নাম স্থানীয় কেউ কখনো শোনেনি। আলহাজ হরজন আলী শিকদার ফাউন্ডেশন ও পাঠাগার এবং চাদমিয়ারহাট মাওলানা সৈয়দ আহাম্মদ ইসলামী পাঠাগার থাকলেও কার্যক্রম নেই। চরফ্যাসনে স্বর্ণকুটির লাইব্রেরি, আব্দুল্লাহপুর আ. জলিল পাঠাগার, অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম স্মৃতি আদর্শ পাঠাগার, উত্তর ফ্যাসন আব্বাসিয়া আদর্শ পাঠাগার, ইউসুফ শরীফ আদর্শ পাঠাগার, হাফেজা হামেলা স্মৃতি পাঠাগার, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার, হাজি আজিদ আলী খান পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই। কাননবালা পাঠাগারটি স্থানীয় কৃষক লীগের নেতা অশোক সাহার বসতবাড়িতে। তবে নেই কোনো কার্যক্রম।
মুন্সীগঞ্জে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পাঠাভ্যাস চর্চাকেন্দ্রের কার্যক্রম চার থেকে পাঁচ বছর বন্ধ রয়েছে। সিরাজদীখান পাবলিক লাইব্রেরি দুই বছর ধরে বন্ধ। যশোরের সৃষ্টিশীল যুব গ্রন্থাগার, স্বপ্ন দেখো গণপাঠাগার, আহম্মদ স্মৃতি পাঠাগার, কবি শিমুল আজাদ গণগ্রন্থাগার, আনোয়ার হোসেন স্মৃতি পাঠাগারের অস্তিত্ব নেই। উপশহর গণগ্রন্থাগার একটি পারিবারিক লাইব্রেরি। পরিবারের সদস্যরা এখানে পড়াশোনা করেন। মনোজ ধীরাজ পাবলিক লাইব্রেরি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় এটির ভেতরে মাকড়সার বাস। ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় কবি নজরুল স্মৃতি পাঠাগার, উত্তর বলতলা আদর্শ পাঠাগার, আবু জাফর মোহাম্মদ ছালেহ পাঠাগার, উপজেলা গণগ্রন্থাগার কাঁঠালিয়া, পল্লি পুনর্গঠন ও পাঠাগার, কাঁঠালিয়া যুব নারী কল্যাণ সংস্থা ও পাঠাগার কেন্দ্র এবং জানশরীফ গণগ্রন্থাগার ও তথ্য সেবাকেন্দ্র পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব নেই। রাজশাহীর শেখ ফজিলাতুন নেসা মুজিব পাঠাগার ও কালচারাল সেন্টার, সাইদুর রহমান পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক সংস্থা, পান্না ও ইসমাইল স্মৃতি সাংস্কৃতিক পাঠাগার, হাসিমুদ্দীন মণ্ডল স্মৃতি পাঠাগার, রহিম বক্স স্মৃতি পাঠাগার, নওশের আলী স্মৃতি পাঠাগার, রুস্তমপুর গণসামাজিক পাঠাগার ও তৃণমূল পাঠাগারে কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাতক্ষীরার মুক্তি গ্রন্থাগার, উন্নয়ন পরিষদ গ্রন্থাগার, পিপলস ডেভেলপমেন্ট পাঠাগার, মানব কল্যাণ গ্রন্থাগার, পি কে ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরি, জাগরণ পাঠশালা ও বসন্তপুর আহছানিয়া লাইব্রেরির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সাতক্ষীরার তালা উপজেলায় মিঠাবাড়ী উন্নয়ন গ্রন্থাগারে অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সেটি সবসময় বন্ধ থাকে বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সাভারের মোহনা পাঠাগারটি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেত্রী ও সাভার গার্লস স্কুলের সাবেক শিক্ষিকা পারভিন ইসলামের বসতবাড়ির একটি কক্ষে পরিচালিত হচ্ছে বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। এ ছাড়া সাভারের মুক্তি গণপাঠাগারে অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে খাতা-কলমে এটির পরিচালক বাংলাদেশ যুব মহিলা লীগের নেত্রী ফরিদা ইয়াসমিন। তিনি নিজ বাসায় পাঠাগারটি পরিচালনা করেন।
পটুয়াখালীর বর্ণ পরিচয় সংঘ ও গণপাঠাগার, শ্রী শচীনন্দন গোস্বামী স্মৃতি পাঠাগার, দোয়েল সমাজ গ্রন্থাগার, বেগম সাফিয়া আদর্শ পাঠাগার, পরী পাঠাগার, মাদার বুনিয়া মৌলভীবাড়ী গণপাঠাগার ও ক্লাবের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে ফজলুল হক স্মৃতি পাঠাগার, ফয়জুল হক ফারুকী ইসলামী পাঠাগার, পূর্ব হকতুল্লাহ আদর্শ পাঠাগার ও সাংস্কৃতিক সংঘ, আ. মালেক শিকদার সাধারণ পাঠাগার, মোসা. আনোয়ারা বেগম সাধারণ পাঠাগার, জনকল্যাণ ট্রাস্ট ও পাঠাগার, গ্রাম. উত্তর পুকুরজানা, ইউনুস সিকদার গণগ্রন্থাগার, রুপালি গণগ্রন্থাগার, গ্রামীণ নারী উন্নয়ন গ্রন্থাগার এবং মোসা. মনোয়ারা বেগম সাধারণ পাঠাগার থাকলেও সচল নয়।
শরীয়তপুরের জাজিরায় ভানুমুন্সির কান্দি পাঠাগারটির পরিচালক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। ঈদ উৎসবে বাড়ি গেলে তিনি এটি খুলে বসেন। বাকি সময় বন্ধ থাকে। তরুণ সংঘ ও পাঠাগার গত ১০ বছরের ওপরে বন্ধ বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সরেজমিন জানালা দিয়ে ভেতরে ভাঙাচোরা চেয়ার-টেবিল ও ধুলাবালুর আস্তরণ দেখা গেছে। এ ছাড়া উমরদি কান্দি পাবলিক গ্রন্থাগার বর্তমানে একটি স্বর্ণের দোকান। আক্কেল আলী মাস্টার স্মৃতি পাঠাগারের কোনো অস্তিত্ব অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মফিদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘ভুয়া লাইব্রেরির বিষয়ে আমরা অনুসন্ধান (ইনকোয়ারি) করছি। ভুয়া লাইব্রেরি যত পাওয়া যাবে, সব বাতিল করা হবে। আর কোনো অনুদান দেওয়া হবে না। এটা আমাদের সিদ্ধান্ত।’
মন্তব্য করুন