বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চায়। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণা করে ভোট আগামী জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করলেও তাতে আপত্তি থাকবে না দলটির। বিএনপি মনে করে, এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সব ধরনের শঙ্কা যেমন কেটে যাবে, দেশও নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করবে। রাজনৈতিক দলগুলোও আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি শুরু করে দিতে পারবে। গত মঙ্গলবার ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি উঠে এসেছে। এর আগে স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে আগামী রমজানের আগে নির্বাচনের যে কথা বলা হয়েছিল, সেটাকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছিল বিএনপি। দলটির মধ্যে এখনো নির্বাচন বানচালের অজানা শঙ্কা রয়েছে। তাই সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষণার মধ্য দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করতে চায় বিএনপি।
আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন আদায়ে ঐকমত্য তৈরিতে গত ১৯ এপ্রিল থেকে ফ্যাসিবাদবিরোদী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএনপি। এ ইস্যুতে ঐকমত্য তৈরির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি। চলমান এসব বৈঠকের কিছু আনুষ্ঠানিক, আবার কিছু বৈঠক অনানুষ্ঠানিক হচ্ছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকটি ছিল রুদ্ধদ্বার। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হচ্ছে গণতন্ত্র মঞ্চ। ছয় দলীয় এ জোটের বক্তব্য বরাবরই গুরুত্বের সঙ্গে নেয় বিএনপি।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে বৈঠকে চার থেকে পাঁচটি ইস্যু উত্থাপন করা হয়। বিএনপি এগুলোর কোনোটির সঙ্গে একমত হয়েছে, আবার কোনোটির সঙ্গে একমত হয়নি। সার্বিকভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের তরফ থেকে আগামী দিনে বিএনপির করণীয় কী, সেটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সূত্রমতে, বৈঠকে গণতন্ত্র মঞ্চের কয়েকজন নেতা বলেন, সংস্কার নিয়ে বিএনপি যথেষ্ট আন্তরিক। কিন্তু সম্প্রতি নির্বাচনের দাবিটি যেভাবে ব্যাপক পরিসরে সামনে নিয়ে এসেছে দলটি, সংস্কার ইস্যুতে নেতারা বক্তব্য-বিবৃতিতে সেভাবে সোচ্চার নন। এতে করে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভুল বার্তা যাচ্ছে। তাই নির্বাচনী রোডম্যাপের পাশাপাশি সংস্কারের রোডম্যাপ নিয়েও সোচ্চার হওয়া দরকার। বিএনপি গণতন্ত্র মঞ্চের এই প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছে।
এ ছাড়া বৈঠকে সংস্কার ইস্যুতে গণতন্ত্র মঞ্চের তরফ থেকে আরও বলা হয়, সংস্কার নিয়ে বিএনপি নেতারা একেক সময় একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে। বিষয়টি বিএনপির বিবেচনায় নেওয়া উচিত, যাতে করে সংস্কারের বিষয়ে বিএনপির আন্তরিকতা নিয়ে কোনো ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।
সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপি নেতাদের চাঁদাবাজি, দখল-বাণিজ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা। তখন বিএনপি নেতারা বলেন, মিডিয়া এটা নিয়ে অতিরঞ্জিত করছে। প্রত্যুত্তরে গণতন্ত্র মঞ্চ বলে, তাহলে বিএনপি এর বিরুদ্ধে পাল্টা বয়ান তৈরি করছে না কেন? বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দলের বিবেচনায় নেওয়া দরকার।
জানা যায়, বৈঠকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) বিষয়টিও একপর্যায়ে আলোচনায় আসে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া নতুন এই রাজনৈতিক দলটি নানা কারণে বর্তমানে আর তেমন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই বলে মনে করছে বিএনপি। নেতাদের অভিমত, এনসিপিকে ঘিরে যেটুকু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটা এখন আর নেই। বিএনপির প্রত্যাশা ছিল, স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ছাত্রনেতাদের দিয়ে গঠিত দলটি রাজনীতিতে নতুন কিছু করবে। কিন্তু রাজনৈতিক দল গঠনের পর গণঅভ্যুত্থান এবং গত ১৫-১৬ বছর ধরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে থাকা বিএনপিকে নিয়ে তারা যে ধরনের বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছেন, সেটা বিএনপিকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। সে কারণে প্রথম দিকে এনসিপির সঙ্গে একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি কিংবা সম্ভাব্য নির্বাচনী জোটে আনার চিন্তা-ভাবনা থাকলেও এখন সেটাতে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। সব মিলিয়ে নতুন দলটির সার্বিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণে রেখেছে বিএনপি।
জানা যায়, বৈঠকে বিএনপির পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, শহীদুল্লাহ কায়সার; বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, আকবর খান; গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, আব্দুল কাদের; গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, আবুল হাসান রুবেল; জেএসডির শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন ও তানিয়া রব ছিলেন।
মন্তব্য করুন