ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে রাজনীতি। নির্বাচনের সময় ঘিরে বিএনপি, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসপি)সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতারা নানা রকম বক্তব্য দিচ্ছেন। কথা বলছেন প্রধান উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ সরকারে থাকা শীর্ষ ব্যক্তিরাও।
বিএনপি শুরু থেকেই স্বল্প সংস্কারের মাধ্যমে ডিসেম্বরে নির্বাচনের কথা বলে আসছে। তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সভা করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ডেটলাইন না পেয়ে চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। দলটি পরবর্তী তিন মাস মাঠে থাকার পরিকল্পনা করছে।
এদিকে জামায়াতে ইসলামী এতদিন সংস্কার শেষে গ্রহণযোগ্য সময়ে নির্বাচনের কথা বলে আসছিল। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে জামায়াত আমির ও নায়েবে আমিরের বৈঠকের পর তারা বলছেন, আগামী রোজার আগেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন দিতে হবে।
এর সঙ্গে দলটি তিনটি শর্ত জুড়ে দিয়েছে। শর্তগুলো হচ্ছে—প্রয়োজনীয় সংস্কার, ফ্যাসিস্টদের বিচার ও সঠিক নির্বাচন পদ্ধতি। দলটির আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, সময়সীমা কঠিন নয়, শর্ত পূরণ হলেই নির্বাচন সম্ভব।
এদিকে, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী প্রশ্ন তুলেছেন, সংস্কারকে কেন নির্বাচন ও ভোটাধিকারের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। তিনি সরকারের নির্বাচনী সময়সীমা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সমালোচনা করে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। বিএনপি সংস্কারের বিরোধী নয় বলে জানালেও তাদের অবস্থান হলো—সংস্কারের মূলে থাকতে হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা।
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সংস্কার শেষ না করে নির্বাচনের বিরোধিতা করে বলেছে, সংস্কারবিহীন নির্বাচন নতুন স্বৈরাচারের জন্ম দিতে পারে। এনসিপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে নির্বাচন হলে তাদের আপত্তি নেই। তবে নির্বাচনের আগে গণঅধিকার পরিষদ নির্বাচন করে সংবিধান পুনর্লিখনের কথাও বলেন দলটির নেতারা।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বুধবার বলেন, ‘আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। ডিসেম্বর থেকে জুন মানে আমরা ইচ্ছা করে দেরি করে মে বা জুন মাসে নির্বাচন করব, সেটা নয়। ডিসেম্বর থেকে জুন মানে হচ্ছে এ সময়ের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’
এদিকে, সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় চলতি বছরের ডিসেম্বর ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষিত টাইমলাইন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি। আর সেটি হচ্ছে ডিসেম্বর। আগামী জুন-জুলাইয়ের মধ্যে এ-সংক্রান্ত রোডম্যাপ প্রকাশ করা হবে।
অন্যদিকে, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে অনড়। সরকারের কথায় বোঝা যাচ্ছে, তারা ডিসেম্বরে
নির্বাচন করতে পারবে না। সরকার আগামী বছরের জুন নাগাদ নির্বাচন করতে চায়। অর্থাৎ এখানে ছয় মাসের সময়সীমা নিয়ে বিরোধ। এটা এখন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে, অন্যথায় জটিলতা সৃষ্টি হবে। বিএনপির বাইরে অন্য রাজনৈতিক দল এবং অংশীজনের মতামতও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত দেখলাম রমজানের আগে নির্বাচন চায়। এর আগে তারা নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা বলেনি, তারা যৌক্তিক সময়ের কথা বলেছে।
তবে এখন হঠাৎ করে রমজানের আগে নির্বাচনের কথা বলায় বিষয়টা অন্যরকম ইঙ্গিত দিচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতিতে যদি রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের মধ্যে ঐকমত্য না হয়, তাহলে গণভোট ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের দিনক্ষণ বিষয়ে অনেকটা বিপরীতমুখী অবস্থানে থাকা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী এখন প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। বড় দুই দলের চাওয়ার মধ্যে সময়ের হিসাবে পার্থক্যটা এক থেকে দেড় মাসের মতো। এ ছাড়া চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে ‘সমমনা ইসলামী দলগুলোও’। অর্থাৎ নির্বাচনী দিনক্ষণ ইস্যুতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যে কিছুটা নৈকট্য বা কাছাকাছি মতামত দেখা যাচ্ছে। তবে ‘মৌলিক সংস্কার’ ইস্যুতে এখনো মতপার্থক্য রয়ে গেছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সম্ভাব্য দিনক্ষণ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছি। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখন আমরা আমাদের দলীয় ফোরামে আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।’
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, নির্বাচনের রোডম্যাপ একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে সামনে এসেছে। এ ইস্যুতে বিরোধী দলগুলোর মধ্যেও আলোচনা, বোঝাপড়ার কিছুটা নৈকট্য দেখা যাচ্ছে।
তারপরও আমার মনে হয়, সরকারের ওপর পরোক্ষ ও মনস্তাত্ত্বিক চাপ রাখার জন্য বিরোধী দলগুলো রাজপথে থাকবে। কারণ বিরোধী দলগুলো মনে করছে, নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার নানান আশঙ্কা রয়েছে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি নানাভাবে ফিরে আসতে পারে। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কাও আছে বিরোধী দলগুলোর।
এদিকে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বললেও সেটা যে ডিসেম্বরে হবে না, এমন কথা বলেননি। তবে এমন প্রেক্ষাপটে দলটি দ্রুত নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকারের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ও পরোক্ষ চাপ অব্যাহত রাখবে।
বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন বিলম্বিত হওয়ার নানা আশঙ্কা এখনো আছে। পরাজিত ফ্যাসিবাদী শক্তি নানাভাবে ফিরে আসতে পারে। এমন অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কাও থাকে।
বিএনপির মতোই অভিমত যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোরও। তাই ঘরোয়া সভা-সেমিনারের পাশাপাশি জেলা, মহানগর ও উপজেলায় সভা-সমাবেশ, পদযাত্রার মতো নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি শুরুর প্রাথমিক সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। তবে সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো কর্মসূচিতে যেতে চায় না দলটি। কারণ, একটি অবাধ-সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে এই সরকারকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করছে বিএনপি। দলটি চায় না যে, এই সরকার ব্যর্থ হোক। জানা গেছে, বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চাইলেও নির্বাচন এক-দেড় মাস পেছালেও তেমন আপত্তি থাকবে না দলটির। সে কারণে সরাসরি নির্বাচনী রোডম্যাপ ইস্যুতে কর্মসূচিতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।
চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচন চেয়েছে ইসলামী দলগুলোর জোট ‘সমমনা ইসলামী দলগুলো’ও। গত বুধবার রাজধানীর পুরানা পল্টনে খেলাফত মজলিসের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই সিদ্ধান্তে ঐকমত্য পোষণ করে দলগুলো।
অন্যদিকে এনসিপি বলেছে, কোনো ধরনের মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের দিকে গেলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। সে নির্বাচনে এনসিপি অংশগ্রহণ করবে কি না, সেটাও বিবেচনাধীন থাকবে। অবশ্য বিএনপিও সংস্কার চায়। এ ব্যাপারে সরকারকে তারা সহযোগিতাও করছে। তবে দলটির অবস্থান হচ্ছে, মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করবে নির্বাচিত সরকার। সব মিলিয়ে মৌলিক সংস্কার ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা হয়নি।
এদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব কালবেলাকে বলেন, ‘এনসিপির মূল দাবি হচ্ছে রাষ্ট্রের শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মৌলিক সংস্কার এবং একই সঙ্গে গত ১৫ বছরে হত্যা, গণহত্যায় অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করা। মৌলিক সংস্কার প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সরকারের ঐকমত্যে পোঁছানো। এসব বিষয়কে এনসিপি ফোকাস করেছে। এ দাবিগুলো যত দ্রুত সময়ে পূরণ হবে; তত দ্রুত সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের সময় নিয়ে আমাদের এত বেশি কনসার্ন নেই। দাবিগুলো যদি পূরণ হয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় ডিসেম্বর বা জানুয়ারি নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই।’
নির্বাচনের ক্ষেত্রে শুধু জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে গণপরিষদ নির্বাচনে জোর দিয়েছে এনসিপি। দলটির নেতারা বলছেন, বারবার ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসা চিরতরে বন্ধ করা, সংবিধান পুনর্লিখন ও শাসন কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন গণপরিষদ। সেই গণপরিষদ নতুন সংবিধান তৈরি করবে এবং সেই সংবিধানের অধীনে হবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে সব পক্ষ চাইলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গেও হতে পারে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ‘যে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, তা আগামী এক মাসের মধ্যেই সমাধান করা সম্ভব। কারণ, সংস্কারের ব্যাপারে বলাই হয়েছে, যেগুলোতে ঐকমত্য হবে, সেগুলো সংস্কার হবে। বাকি যেসব সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারবে না, সেটা নির্বাচিত সংসদ করবে। সুতরাং ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন হতে পারে।’
মন্তব্য করুন