বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবারের ঈদের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। রাজনীতি, অর্থনীতি, ঈদযাত্রা থেকে শুরু করে মৌলিক বিষয়ে অনেকটাই স্বস্তিতে দেশের মানুষ। বিশেষ করে স্বস্তির ঈদযাত্রায় খুশি ঘরমুখো মানুষ। মহাসড়কে পুলিশের কড়াকড়িতে খুশি তারা। সাধারণ মানুষের ভাষ্য, বিগত সরকারের আমলে ঈদযাত্রা মানেই দেখা গেছে দুর্ভোগের এক চিরাচরিত দৃশ্য।
ঈদে ঘরমুখো মানুষ নির্বিঘ্নে গন্তব্যে যাচ্ছেন। পবিত্র রোজার মাসে অন্যবারের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটাই সহনীয়। লোডশেডিংও ছিল কম। রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয়ের রেকর্ড ভাঙায় ‘অর্থনীতিও চাঙ্গা’।
আবার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে হতাশা থাকলেও অনেক বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে কূটনৈতিক অঙ্গনেও সরকারের প্রশংসা হচ্ছে। চার দিনের চীন সফর শেষে গতকাল শনিবার দেশে এসেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঐতিহাসিক এই চীন সফরেও অর্জন কম নয়। সব মিলিয়ে সরকারও স্বস্তিতে রয়েছে। তবে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক জটিল সমীকরণ তৈরি হয়েছে।
নির্ধারিত সময়ে ভোট হবে কি হবে না, সে বিষয়ে দোলাচল দেখা দিয়েছে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি চলতি জুনের মধ্যেই নির্বাচন চায়। তবে ডিসেম্বরে হলেও মেনে নেবে। তা না হলে আবারও রাজপথের আন্দোলনে নামার হুঁশিয়ারি দিয়েছে দলটি। আবার পরাজিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের বিচার এবং তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবিতে ঈদের পর বড় ধরনের কর্মসূচিতে যাওয়ার চিন্তা করছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। একই সঙ্গে তারা সংসদ নির্বাচনের আগে গণপরিষদ নির্বাচন দাবি করেছে।
তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে কয়েকটি বামপন্থি রাজনৈতিক দলও। অন্যদিকে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামী ধারার দলগুলো সব সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলেছে। এতে নির্বাচন বিলম্ব হলেও তাদের আপত্তি নেই।
সম্প্রতি অর্থনীতিসহ নানা কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার চলছে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য রেখে দেওয়া। এনসিপির কোনো কোনো নেতাও এমন প্রচারে শামিল হচ্ছেন। ফলে নানা কারণে দেশের মানুষের মধ্যে আশা থাকলেও সবার মনের ভাবনা এখন ঈদের পরবর্তী সময় নিয়ে।
যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে বা আগামী বছরের জুনে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সে মোতাবেক প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশনও।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পলায়ন ও আওয়ামী লীগের পতনের পর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। শুরুতেই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি ওঠে সর্বস্তরে। এরপরই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ খাতের কতগুলো সংস্কার কমিশন গঠন করেন।
এরই মধ্যে প্রায় সব কমিশন তাদের সংস্কার প্রস্তাব বা রূপরেখা প্রধান উপদেষ্টার কাছে হস্তান্তর করেছে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপও করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সংস্কার ইস্যুতে মতামত পেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তরফে একাধিকবার বলা হয়েছে যে, আগে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার।
এরপর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে গণহত্যাকারী শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার করা হবে। তারপর একটি গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদায় নেবে। সে মোতাবেক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের অগ্রাধিকার বিষয় হলো— রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কার, গণহত্যাকারীদের বিচার এবং সবশেষে একটি সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
অন্যদিকে বিএনপি শুরু থেকেই সরকারকে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা দেখা করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব এবং নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে দলটি। এই ইস্যুতে সর্বশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে দেশের সব বিভাগ ও মহানগরে সমাবেশও করেছে বিএনপি। বিএনপি শুরু থেকেই দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলে আসছে।
জামায়াতে ইসলামী চাইছে সংস্কার শেষে ‘যৌক্তিক সময়ের’ মধ্যে নির্বাচন। অন্যান্য দলের অবস্থানও কমবেশি একই। কিন্তু ছাত্রদের নতুন দল এনসিপি বলছে, গণপরিষদ নির্বাচনের কথা। যেটাকে বিএনপি দেখছে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র হিসেবে। যদিও সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন আগে—এমন প্রশ্নের মধ্যে দ্রুত নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক চাপ তৈরি করে বিএনপি। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে আগামী ডিসেম্বরকে ধরে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়সীমার কথা জানিয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য সংস্কার চলতে পারে না। মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিএনপি এখন রাস্তায় নামে না। কিন্তু দল ও দেশের জনগণের স্বার্থে আঘাত এলে প্রয়োজনে বিএনপি আবার মাঠে নামবে। তিনি বলেন, বিএনপি সব পরিবর্তন এনেছে, সংস্কার বিএনপি করেছে। একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাও বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ধোঁয়াশা তৈরি করা হচ্ছে। ডিসেম্বর না জুন না মার্চ, একেক সময় একেক কথা। এটা তো শেখ হাসিনার কিছু কথাবার্তার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। কেন এটা হবে? অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের রক্তের ওপর গঠিত সরকার। সেই সরকার জনগণের কাছে নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে মাসের কথা বলে তারা একটা নির্বাচনের প্রক্রিয়া তৈরি করবে। আমরা কখনো শুনছি ডিসেম্বর, কখনো শুনছি মার্চ, কখনো আবার জুন—এ ধরনের একটা পেন্ডুলামের মতো বক্তব্য ঝুলছে, সরকারের এই দোলায়মান অবস্থা থেকে জাতিকে একটি নির্দিষ্ট তারিখ দিয়ে স্পষ্ট করা দরকার।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের সেক্রেটারি ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ১৯৭১ সালের অর্জিত স্বাধীনতায় জাতি স্বাধীন ভূখণ্ড আর লাল-সবুজের পতাকা পেয়েছে। এটি ছিল পাকিস্তানের শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত হয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের স্বাধীনতা। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট অর্জিত স্বাধীনতা এদেশের মানুষের কথা বলার, সভা-সমাবেশ করার, মুক্ত চিন্তার স্বাধীনতা। এটি ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদের সেবাদাস আওয়ামী লীগের শাসন-শোষণ থেকে জাতিকে মুক্ত করার স্বাধীনতা। যারা ৫ আগস্টকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকার করে না, তারা ইতিহাসের পাতার সবচেয়ে নিকৃষ্ট অকৃতজ্ঞ। তিনি আরও বলেন, যারা সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় তারা আসলে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন চায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মাদ মাহবুবুর রহমান গতকাল কালবেলাকে বলেন, একটা কথা সত্য যে, কিছুদিন ধরে বিশেষত রোজার মাসে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা, লোডশেডিং কম হওয়া, স্বস্তির ঈদযাত্রাসহ বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো ঈদের পর আন্দোলনের কথা বললেও সেটি তারা অত সহসায় করবে বলে মনে হয় না। মূলত তারা সরকারকে নির্বাচনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতেই আন্দোলনের কৌশলের কথা বলছেন। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বেড়েছে। যে কারণেই সরকার ২৬ সালের জুনের দিকে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলতে পারছে।
এদিকে এবারের ঈদযাত্রায় যানজটের সঙ্গে ডাকাতি ও ছিনতাই নতুন আতঙ্ক হিসেবে দেখা দেয়। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা উদ্যোগের কারণে সড়কপথে যানজটের ভোগান্তি না থাকায় কিছুটা স্বস্তি রয়েছে। ঈদের আগের দুদিন মহাসড়কগুলোতে গাড়ির চাপে যানজট সৃষ্টি ও জনভোগান্তির আশঙ্কা থাকলেও এবার অন্তত সেটি খুব বেশি হয়নি। হাইওয়ে পুলিশ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে সচেতন থাকায় এমনটি সম্ভব হয়েছে।
বিশেষ করে সারা দেশের মহাসড়কগুলোতে ১৩৭টি স্পট চিহ্নিত করে যানজটমুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। হাইওয়ে পুলিশ জানায়, এবার সব আশঙ্কা মাথায় রেখেই ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তাসহ সব সদস্য দিন-রাত সড়কে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি জেলা পুলিশ, র্যাব ও যৌথ বাহিনীর সদস্যরাও যানজট নিরসন ও মহাসড়কের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করছেন।
সরকারের প্রতি আস্থা ফিরেছে সাধারণ মানুষের: এবারের পবিত্র রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যে স্বস্তিতে ছিল মানুষ। গত বছরের রোজার সময়ের তুলনায় চলতি রোজায় বাজারমূল্য নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ৯৫ শতাংশ মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও ভিডিও প্ল্যাটফর্মে কালবেলার পক্ষ থেকে কয়েকটি মতামত জরিপে এমন তথ্যই উঠে এসেছে। মতামত জরিপে প্রায় ৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ অংশ নেন। যার মধ্যে ৫ লাখ ৯৬ হাজার মানুষ সন্তুষ্টি ও ৩৪ হাজার মানুষ অসন্তুষ্টি জানিয়েছে। রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে ভোক্তার সন্তুষ্টির বিষয়ে গত ১৮ ও ১৯ মার্চ কালবেলার ওয়েবসাইটে ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েকটি অনলাইন জরিপ চালানো হয়। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের কাছে এবারের রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ে তারা সন্তুষ্ট কি না প্রশ্ন রাখা হয়।
এর মধ্যে গত ১৮ মার্চ কালবেলার ইউটিউব চ্যানেলে চালানো জরিপে ‘গত রমজানের চেয়ে এ রমজানে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে আপনি কতটা সন্তুষ্ট? এই প্রশ্নের সম্ভাব্য ৪টি উত্তর রাখা হয়। ৪টি অপশনে মোট মতামত দেন ৩ লাখ ৬১ হাজার মানুষ। এর মধ্যে শতভাগ সন্তুষ্ট অপশনে মতামত দেন ৮০ শতাংশ বা ২ লাখ ৮৮ হাজার, ৫০ ভাগ সন্তুষ্ট অপশনে মতামত দেন ১১ শতাংশ বা ৩৯ হাজার, ২৫ ভাগ সন্তুষ্ট অপশনে মতামত দেন ১০ হাজার ও শূন্য ভাগ সন্তুষ্ট অপশনে মতামত দেন ৬ শতাংশ বা ২১ হাজার মানুষ।
মন্তব্য করুন