পরিবর্তিত সময় এবং লম্বা ছুটি মিলিয়ে আগে থেকেই ঈদের খুশিতে ভাসছে দেশ। এই খুশি আরও বাড়বে ঈদের নতুন জামা পরার পর। এবার ঈদটা স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য বারের চেয়ে ভিন্ন। ফলে এবার খুশির মাত্রাটাও অন্যরকম। লম্বা ছুটির কারণে মানুষ কেনাকাটা সেরে নিয়েছেন আগেভাগেই। ঈদ উপলক্ষে কেনাকাটাও বেড়েছে অন্যান্যবারের চেয়ে বেশি। ফলে স্বস্তিতে দেশের অর্থনীতি। এবার আড়াই লাখ কোটি টাকার ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।
বরাবরের মতো এবারও বড় বড় শপিংমলের নামি-দামি ব্র্যান্ডগুলোয় পোশাক, জুতা, বেল্ট, সানগ্লাস, ঘড়ি, কসমেটিকস, জুয়েলারিসহ অন্যান্য পণ্যের কেনাকাটা বেড়েছে। পাশাপাশি এবার ঈদে খোলা বাজারেও ভালো ব্যবসা হয়েছে।
রাজধানীর বিভিন্ন মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, ঈদুল ফিতর ঘিরে বিপণিবিতানগুলোয় চলছে জমজমাট কেনাকাটা। শেষ সময়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত অনেকে। নামিদামি ব্র্যান্ডের পোশাকের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেশি। সেইসঙ্গে জমে উঠেছে খোলা বাজারে বেচাকেনা। তুলনামূলক দাম কম হওয়ায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড় বাড়ছে খোলা বাজারে। রমজানের আগে থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন শপিংমল ও বিপণিবিতান সেজে উঠেছিল বাহারি পোশাকে। তবে কেনাকাটা জমতে শুরু করে রমজান মাস শুরুর পর। এখন ঈদের প্রাক্কালে জমে উঠেছে ব্যবসা।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এবার ঈদ উৎসব ঘিরে ব্যবসায়ীদের বিক্রি ভালো হয়েছে। এর সুফল অবশ্যই অর্থনীতিতে পড়বে। সংশ্লিষ্টদের ওপর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, যা খালি চোখে দেখা যাবে না। ঈদ ঘিরে এমন জমজমাট কেনাকাটায় অবশ্যই অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির ব্যবসায়ীরা জানান, ২০২৪ সালে ঈদ ঘিরে ব্যবসা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার। ২০২৩ সালে ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা হয় ১ লাখ ৮৭ হাজার কোটি টাকার। এবার আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, এবারের ঈদকেন্দ্রিক ব্যবসা পরিস্থিতি বেশ ভালো। পোশাকের পাশাপাশি অন্যান্য পণ্যও ভালো বিক্রি হয়েছে। এবার ব্যবসায়ীরা খুশি, ক্রেতারাও খুশি। সবাই মন খুলে কেনাকাটা করেছেন। তবে পণ্যের দাম কিছুটা বেশি। এবার আড়াই লাখ কোটি টাকার ব্যবসা হবে বলে আমাদের আশা। আর তা না হলেও প্রত্যাশার কাছাকাছিই থাকবে।
চাহিদা বেশি পাঞ্জাবি, থ্রি-পিসের: ঈদের কেনাকাটায় মেয়েদের পোশাকের চাহিদা বরাবরের মতোই বেশি। থ্রি-পিস, শাড়ি, বোরকা, কুর্তির প্রতি বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। পুরুষদের পাঞ্জাবির দোকানগুলোয় উপচে পড়া ভিড়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছেলেদের পোশাকের মধ্যে পাঞ্জাবিই বেশি বিক্রি হচ্ছে। আর মেয়েদের পোশাকের মধ্যে থ্রি-পিস। এবারও দেশি তাঁতে বোনা শাড়ি, জামদানি প্রিন্টের হাফ সিল্ক শাড়ি, সুতি শাড়ির প্রাধান্য থাকছে। হালকা সবুজ, আকাশি, ঘিয়ে, ধূসর, হালকা গোলাপি রং দেখা যাচ্ছে বেশি। এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকার মধ্যে ক্রেতারা পেয়ে যাচ্ছেন হাফ সিল্ক, তাঁতের শাড়ি।
অনেক দোকান ঈদ উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে ক্রেতা সমাগম বেশি। বসুন্ধরা, যমুনা ফিউচার পার্কসহ রাজধানীর বড় শপিংমলগুলোয় ইয়েলো, টুয়েলভ, সেইলর, টেক্সটমার্ট, ওয়েস্টিন, নোয়ার, ওকোড, জেন্টল পার্ক, আর্ট, ইনফিনিটি, আড়ং, রাইজ, রিচম্যান, স্টাইলিশ আবিয়া বোরকা, মনেরেখো শাড়িজ, শালিমারের মতো দোকানগুলোয় ক্রেতাদের আনাগোনা বেশি।
ছোটদের পোশাক দিয়ে কেনাকাটা শুরু করেন বাবা-মায়েরা। ছোট-বড় সব ব্র্যান্ডই ছোটদের জন্য জমকালো নকশা আর বৈচিত্র্যময় ডিজাইনের পোশাক নিয়ে এসেছে। শত শত ডিজাইন ও কালারের মাঝে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পোশাক বেছে নিচ্ছে শিশুরা। চাহিদার সঙ্গে পছন্দমতো বাচ্চাদের জন্য পাঞ্জাবি ও শার্ট কিনছেন অভিভাবকরা। ঈদ বাজারে এবার শিশুদের পণ্যে দখল করে রেখেছে পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, টিশার্ট, প্যান্ট, কাবলি সেট। তবে, ঈদ এবার গরমে হওয়ায় সুতি কাপড়ের পোশাকের চাহিদা বেশি। চাহিদা আছে লিলেন, কটন, সিল্ক, অ্যান্ডি সিল্ক কাপড়ে তৈরি বিভিন্ন পোশাকেরও। শিশুদের পোশাকের দাম বেশি, বলছেন ক্রেতারা।
বিভিন্ন পোশাকের দাম গতবারের চেয়ে বেশি: পল্টন গাজী ভবনে শপিংয়ে এসেছেন চাকরিজীবী ইমন চৌধুরী। তিনি বলেন, ঈদের কেনাকাটায় বেশি ব্যয় হয় পোশাকের জন্য। নতুন পোশাকের পাশাপাশি তালিকায় থাকে জুতা, বেল্ট, অর্নামেন্টস, প্রসাধনীও। তবে মূল ব্যয় পোশাকে। এবার বিভিন্ন পোশাকের দাম বেড়েছে। গত বছর যে মানের পাঞ্জাবি কিনেছিলাম ২ হাজার টাকায়, এবার তা কিনতে লেগেছে ৩ হাজার। এভাবে সব পোশাকই গতবারের চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়েছে।
বড় শপিং মলের পাশাপাশি খোলা বাজারের ব্যবসাও এবার চাঙ্গা: টিকাটুলির রাজধানী সুপার মার্কেটে কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেউ ঈদ উপলক্ষে শুধু পোশাক কিনছেন। আবার অনেকে নতুন পোশাকের পাশাপাশি কিনেছেন জুতা, অর্নামেন্টস, প্রসাধনীসহ অন্যান্য পণ্য। নতুন পোশাক, জুতা, অর্নামেন্টস, প্রসাধনী—সব পণ্য কেনার কথা বলেছেন অন্তত ২১ জন। নতুন পোশাকের পাশাপাশি যারা অন্য পণ্য কিনেছেন, তাদের বেশিরভাগই জানান, শুধু পোশাকের জন্য ব্যয় হয়েছে ৭০-৮০ শতাংশ অর্থ। তবে গতবারের চেয়ে এবার পোশাকের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ১ হাজার টাকা।
গেন্ডারিয়া থেকে রাজধানী সুপার মার্কেটে শপিংয়ে এসেছেন সিনথিয়া হক। তিনি বলেন, ‘ঈদের কেনাকাটা বলতে আমি মূলত বুঝি পোশাক কেনা। প্রতিবছরই ঈদে নতুন পোশাক কিনি, এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। আব্বু টাকা দিয়েছেন, আমি আমার পছন্দ মতো থ্রি-পিস কিন। থ্রি-পিসের সঙ্গে মিলিয়ে এক জোড়া কানের দুল কেনার ইচ্ছা আছে।’
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সে পরিবার নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা চাকরিজীবী নিলয় আহমেদ বলেন, আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছি। সবাই নিজের পছন্দ অনুযায়ী কেনাকাটা করছি। নতুন পোশাক তো আছেই, নতুন জুতা, কসমেটিকস কেনার ইচ্ছা আছে।
শেষ সময়ে ক্রেতা কমায় কিছুটা ধীরগতি: ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় অনেকেই আগেভাগে রাজধানী ত্যাগ করেছেন। ফলে দোকানগুলো অন্যান্যবারের চেয়ে এবার কিছুটা কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, লম্বা ছুটির কারণে অনেকে আগেই কেনাকাটা করে গ্রামে চলে গেছেন। তাই এবার একদিন বা দুদিন আগে আগের মতো ব্যবসা হবে না। তবে ব্যবসা ভালো হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এবার ব্যবসা ভালো হয়েছে বলা যায়।
মন্তব্য করুন