রকি আহমেদ
প্রকাশ : ০৪ মার্চ ২০২৫, ০২:৩৬ এএম
আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৫, ১০:৫৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আদালতে ডিবির তদন্ত রিপোর্ট

মিল্টন সমাদ্দারের জালিয়াতির হাতেখড়ি ছোটবেলাতেই

‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এর চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। পুরোনো ছবি
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এর চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দার। পুরোনো ছবি

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’-এর চেয়ারম্যান মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, জালিয়াতি করে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি ও মানব পাচারের অভিযোগে হওয়া মামলা তদন্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তদন্তে উঠে এসেছে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য।

গত বছরের ২ মে ‘মানবিক মুখোশের আড়ালে ভয়ংকর মিল্টন সমাদ্দার’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক কালবেলা। সেই প্রতিবেদনে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে আসা অনেক অভিযোগেরই সত্যতা মিলেছে ডিবির তদন্তে।

ডিবির তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, ডাক্তার না হয়েও নিজেই ছুরি-ব্লেড দিয়ে আশ্রমের অসুস্থদের কাটাছেঁড়া করেন মিল্টন। প্রয়োজনে নিজেই হাত-পা কেটে ফেলেন। ফেসবুকে ৯০০ জনের লাশ দাফন করেছেন স্ট্যাটাস দিলেও বাস্তবে দাফন করেছেন ১৫০ জনের লাশ। এ ছাড়া নিজে স্বাক্ষর দিয়ে ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেটও তৈরি করেন মিল্টন সমাদ্দার। এমন সব অপরাধ আড়াল করে নিজেকে মানবতার ফেরিওয়ালা সাজিয়ে মিল্টন ফেসবুকে তার ১ কোটি ৬০ লাখ ফলোয়ারের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে কোটি টাকা আয় করেন। তার ১৪টি ব্যাংক হিসাবে মিলেছে ১ কোটি ৮০ লাখ ৯৫ হাজার ৩৮৩ টাকা।

আশ্রমের মানুষজনকে নির্যাতন করার বিষয়টিও উঠে এসেছে ডিবির তদন্তে। মতিউর রহমান মল্লিক নামে এক ব্যক্তিকে মারধর ও হত্যাচেষ্টা মামলায় মিল্টন সমাদ্দার ও তার স্ত্রী মিঠু হালদারকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া জালিয়াতির মাধ্যমে ডেথ সার্টিফিকেট তৈরির মামলায় মিল্টন সমাদ্দার ও তার হেলথ কেয়ারের ম্যানেজার কিশোর বালাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। এ ছাড়া মানব পাচারের মামলাতেও চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় জামিনে কারামুক্ত হয়ে ফেসবুকে ফের মানবতার ফেরিওয়ালা সেজে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন মিল্টন। নিয়মিত ভিডিও পোস্ট করে অনুদান চাইতেও দেখা যায় তাকে।

জালিয়াতির শুরু ছোটবেলা থেকেই: বরিশালের উজিরপুর থানার ডহরপাড়া গ্রামের সামাদিয়া দারুল উলুম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই নানা ধরনের জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত মিল্টন সমাদ্দার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রধান শিক্ষকের স্বাক্ষর জাল করে সার্টিফিকেট তৈরির অপরাধে স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মিল্টন একবার তার এলাকার এক ছেলেকে মারধর করে গুরুতর আহত করেন। ওই ঘটনায় তার বাবা বেদু সমাদ্দার তাকে শাসন করতে গেলে মাছ মারার টেঁটা দিয়ে বাবাকে কোপ দেন মিল্টন। পরে তিনি বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকায় এসে প্রথমে ওষুধ ব্যবসায় যুক্ত হন তিনি। পরে নার্সিং প্রশিক্ষণ নেন। বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে চাকরি করার পর ২০১৬ সালে অসুস্থ বয়স্কদের নিয়ে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন।

প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অনিয়ম ও প্রতারণা: ২০১৭ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন নেন মিল্টন। কোনো পরিচালনা পর্ষদ গঠন করেননি। এরপর ২০১৯ সালে মিল্টন তার নিজ বাড়ির পাশেই ‘চন্দ্রকান্ত মেমোরিয়াল চার্চ’-এর কমিটিতে স্থান পাওয়ার জন্য ধর্ম মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সহকারী সচিব মো. তরিকুল ইসলামের স্বাক্ষর জাল করেন। পরে বিষয়টি ধরা পড়ে বলে ডিবির তদন্তে উঠে এসেছে।

ডাক্তার না হয়েও নিজেই করেন অপারেশন: ডিবির চার্জশিটে বলা হয়েছে, মিল্টন সমাদ্দার রাস্তায় কোনো অসুস্থ বয়স্ক, পচা গলা, পাগল, প্যারালাইজড লোক বা অটিস্টিক শিশু অভিভাবকহীন অবস্থায় পড়ে আছে খবর পেলে লোকজনের মাধ্যমে রাস্তা থেকে তুলে অফিসে আনতেন। পরে তার আশ্রমের অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে নিজেই তাদের ক্ষতগুলো পরিষ্কার করতেন। মানুষকে ধোঁকা দিতে নিজের প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারদের ভুয়া নাম লিখে বোর্ডে লাগিয়ে রাখতেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানে কোনো ডাক্তার নেই। তিনি নিজেই অপারেশন করে নিজেই তাদের চিকিৎসা করতেন। মিল্টন তার প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার কিশোর বালার সহযোগিতায় বয়স্কদের শরীরে কোন পচন বা গ্যাংগ্রিন থাকলে নিজেই ব্লেড দিয়ে কাটাছেঁড়া করতেন। প্রয়োজনে নিজেই হাত-পা কেটে ফেলতেন। ব্লেড, ছুরি দিয়ে কাটাছেঁড়ার ফলে অধিক রক্তক্ষরণের কারণে চিৎকার করলেও তাতে কর্ণপাত করতেন না মিল্টন।

আশ্রমে অত্যাচার: মিল্টন সমাদ্দার তার আশ্রমে যাদের নিয়ে আসতেন তাদের বেশিরভাগ প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ ও প্যারালাইজড। এসব বয়স্ক, প্রতিবন্ধী ও প্যারালাইজড মানুষ বেশিরভাগ সময় অস্বাভাবিক আচরণ করলে তার লোকজন তাদের শারীরিক নির্যাতন করত। অনেক সময় অসুস্থ বা প্যারালাইজড রোগীদের আহত করে তাদের শরীরে অসংখ্য ক্ষত তৈরি করা হতো। এরপর মিল্টন নিজেই এসব ঘা বা ক্ষত অপারেশন করে সেলাই করতেন।

ফেসবুকে প্রতারণার কৌশল: মিল্টন সমাদ্দার ও তার সহযোগীরা পচন, ক্ষত, প্যারালাইজড, অসুস্থ বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে ভিডিও, ছবি বানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আপলোড করে মানবতার ফেরিওয়ালা সেজে বিভিন্ন অঙ্কের অনুদান নিয়ে আর্থিক লাভবান হন। ফেসবুকে তার ফলোয়ারের সংখ্যা ১ কোটি ৬০ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে মিল্টন সমাদ্দার কোটি টাকা অনুদান নিলেও আশ্রমের অনাথ মানুষের চিকিৎসার জন্য কোনো টাকাই খরচ করেন না।

লাশ দাফনের মিথ্যা তথ্য: মিল্টন সমাদ্দার ৯০০ লাশ দাফন করেছেন বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু বাস্তবে ১৫০ জন লাশ দাফন করেছেন বলে আসামি নিজেই জানান। বেশি লাশ দাফনের কথা বললে মানুষের কাছ থেকে বেশি টাকা পাওয়া যায়, এজন্য সে মিথ্যা তথ্য ফেসবুকে আপলোড করে মানুষকে প্রতারিত করেছেন। তারা অপরাধমূলকভাবে জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে সেই মৃত ব্যক্তির সৎকারের জন্য টাকা উঠাতেন। এ ছাড়া এক এনআইডি ব্যবহার করে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে একাধিক লাশ দাফন করেছিলেন বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।

অপরাধের আইনগত দিক: ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেট তৈরির মামলার চার্জশিটে বলা হয়েছে, আসামি মিল্টন ও ম্যানেজার কিশোর বালার বিরুদ্ধে প্রতারণা করার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২০ ধারা, ডকুমেন্ট জালিয়াতি করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করায় ৪৬৭ ধারা, ভুয়া জাল স্বাক্ষর করে ভুয়া ডেথ সার্টিফিকেটে তৈরিতে ৪৬৮ ধারা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচারের অপরাধে ৪৭১ ধারায় অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

মিরপুর মডেল থানার সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা এসআই রফিকুল ইসলাম বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে করা দুটি মামলার চার্জশিট দাখিল করেছে তদন্ত কর্মকর্তা। আগামী ২০ মার্চ চার্জশিটগুলো আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

হত্যাচেষ্টা ও মানব পাচার দুই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক আতাউর রহমান বলেন, মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও মানব পাচার দুই মামলাতেই যে অভিযোগ ছিল তার সত্যতা পাওয়া গেছে। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছি। ২০ হাজার টাকায় ২ বছরের এক শিশুকে নিঃসন্তান এক দম্পতির কাছে বিক্রি করে দেন মিল্টন সমাদ্দার।

এদিকে চার্জিশিটের বিষয়ে মিল্টন সমাদ্দারের আইনজীবী ওহিদুজ্জামান বলেন, এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, আমি চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। আমার মক্কেল তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারেনি বলে তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। আমরা এটা আইনিভাবে মোকাবিলা করব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

মোহাম্মদপুরের ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ শয়ন গ্রেপ্তার 

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আসনের বিপরীতে লড়বে ৬৪ জন

হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা গোলাম মর্তুজা গ্রেপ্তার

নরসিংদীতে ফিলিং স্টেশন বন্ধ ঘোষণা, ভোগান্তি চরমে

মেহেরপুরে ইসলামী ব্যাংকের ভল্ট কেটে ৮ লাখ টাকা চুরি

পতেঙ্গায় পুলিশ সদস্যকে মারধরের ঘটনায় সবাই গ্রেপ্তার 

হুমকির পর কিশোরের লাশ মিলল মাতামুহুরি নদীতে

জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে সোনারগাঁয়ের তুহিন

হবিগঞ্জে মাইকে ঘোষণা দিয়ে সংঘর্ষ, আহত ২০

হাতিরঝিলে চলন্ত গাড়িতে আগুন

১০

আদালতে সাদিক এগ্রোর ইমরান, কারাগারে আটক রাখার আবেদন

১১

শিবিরের আয়ের উৎস কোথায়, জানালেন ঢাবি শিবির সভাপতি

১২

বার্সায় ফেরার জন্য নেইমারকে পূরণ করতে হবে কঠিন শর্ত

১৩

৯১ দিনে কোরআনের হাফেজ ৬ বছরের আব্দুর রহমান 

১৪

‘ভারতে আটক বাংলাদেশিদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা পাওয়া গেছে’

১৫

এখনো নিখোঁজ ৩৩০, বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ : গুম কমিশন

১৬

চার মাসের বেতন পাননি সাকিব!

১৭

সীমান্তে বায়রাক্টার ড্রোন উড়াচ্ছে বাংলাদেশ, এএনআইয়ের প্রতিবেদন

১৮

এভাবে দেশ চলে না : ডা. জাহিদ

১৯

গুমের দায় ব্যক্তির, বাহিনীর নয় : কমিশন

২০
X